বৌদি হয়নি এখনও গো…একটু বসবে….এই কাজটা সেরেই তোমারটা ধরছি…তোমারটা হয়েই এসেছে….আরেকটু বাকি……
তন্দ্রা বসল। মোবাইলে সময় দেখল, আটটা বেজে দশ। মৌ কাজ করছে। তার থেকে ছোটো। একাই দোকানটা খুলেছিল। কী ছোটো ছিল। একজন ঢুকলে আরেকজনকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এখন….
তন্দ্রার বয়েস চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। গত বছর স্বামী মারা গেছে। একটা ছেলে আছে, এবারে মাধ্যমিক দেবে।
দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসে বসে তন্দ্রা রাস্তার পাশে বড় অশ্বত্থ গাছটাকে দেখছে। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। ঠাণ্ডা হাওয়া। আরাম লাগছে। মনের ভিতরে এমন একটা শান্ত স্থির আরাম পাওয়া যায় নিজেকে নিয়ে কয়েক মাস হল বুঝতে শিখেছে তন্দ্রা। আগে একা বেরোত কোথায়? সব ওর সঙ্গে। এমনকি এই সব শাড়ির ফলস লাগানো, ব্লাউজ সেলাই করা…সব ও আসত। বলত, কী করবে বেরিয়ে? ভালো লাগত। মনে হত এত আগলে রাখে! কিন্তু আগল যে সত্যিই ভিতরে ভিতরে এমন হাঁফ ধরিয়ে রেখেছিল…. এখন বুঝতে পারে। একটা শিরশিরে সুখ হয়। লজ্জাও লাগে, অপরাধীও লাগে। এমন অনুভব তো হতে নেই….কিন্তু সে ‘'নেই’ কতদূর আটকাতে পারে মানুষকে?
তন্দ্রার কী মনে হল, দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, মৌ আমি একটু হেঁটে আসছি….তুই করতে থাক। ছেলেটাও দেরি করে ঢুকবে বাড়ি। তাড়া নেই। বাড়ি গিয়েই বা কী করব?
আসলে বাড়ি গিয়ে কী করব না.. এখানে থাকতে ভালো লাগছে। এই হাঁটতে। এই দেখতে। এই হাওয়ার মধ্যে ভাসতে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা চায়ের দোকান পড়ল। একজন বয়েসের ভারে কুঁজো হয়ে যাওয়া মানুষ। ময়লা ধুতি গায়ে, হাড় বেরোনো খালি গা, বসে আছে টুলে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে। দোকানে দুটো খালি তাক। মাত্র একটা কী দুটো কাঁচের জার। তার তলানিতে দুটো চারটে বিস্কুট। মাটির উনুন। আঁচ জ্বলছে ধিকিধিকি। পাশে চায়ের কালো- বাদামী রঙের সসপ্যান। হাতলটা ভাঙা। পাশে প্লাস্টিকে চায়ের কৌটো। চিনির কৌটো। দোকানে টিমটিমে হলুদ বালবের আলো।
কে যেন টেনে আনল। তন্দ্রা বলল, চা হবে?
বৃদ্ধ তন্দ্রাকে রাস্তা পার হয়ে এদিকে আসতে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সোজা তো দাঁড়াতে পারে না, হাত দুটো দিয়ে দোকানের সামনের উঁচু জায়গায় ভর দিয়ে মাথাটাকে বেশ জোর করেই উঁচু করে তাকিয়েছিল। তন্দ্রার প্রশ্নটা শুনে বলল, দুধ শেষ মা….লিকার বানাই?
তন্দ্রা বলল, হ্যাঁ…. চিনিও দেবেন না…আমি চিনি খাই না….দুধও না।
বৃদ্ধের মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটল। চায়ের জল চাপিয়ে টুলে বসল আবার। বলল, কড়া লিকার না হালকা, মা?
তন্দ্রা বলল, হালকা।
হাওয়া দিচ্ছে। তন্দ্রার অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করছে। বৃদ্ধের ফেলে আসা জীবনের কয়েকটা বাঁকে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কে বেশি একা?
চা কাগজের কাপে দিল। নিজেও এক কাপ নিল। চায়ে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বলল, ঠিক হয়েছে মা? আজ আসলে সন্ধ্যে থেকে কেউ আসেনি….একা একা চা বানিয়ে খেতে কেমন লাগে…..
তন্দ্রা হাসল। বলল, দারুণ হয়েছে।
দুজনেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চা-টা হাতে ধরে থাকছে। আঙুলগুলো কাপের গায়ে বুলাচ্ছে তন্দ্রা। “একা একা লাগে না?”.....
বৃদ্ধ মাথাটা উঁচু করে তাকাল। বলল, এই বয়সে এই তো হয় মা…সবাই একা হয়ে যায়….
তন্দ্রার অভিমান হল। তবে তার কেন একা হতে হল? হঠাৎ করে বৃদ্ধকে, এই দোকানের আলো, আগুন, চা সব কিছুকে বিষণ্ণ মনে হল। বিষণ্ণ মনে হতেই ঘাম হতে শুরু করল। বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। দাম জিজ্ঞাসা করে কোনো রকমে টাকাটা দিয়ে মৌয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। মৌ তার আসার আওয়াজ পেয়ে মাথাটা তুলে তাকিয়ে বলল, এই তোমাকে এরকম লাগছে কেন? জল খাবে?
তন্দ্রা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, অনেকটা হেঁটে ফেলেছি। তুই কর। আমি বসি।
খুব একা লাগছে। কান্না পাচ্ছে। সে সুখটাকে ডাকলেও আসছে না। কোথাও কোনো গর্ব নেই এইভাবে বেঁচে থাকার। সব শেষ।
মৌ শাড়িটা একটা প্লাস্টিকে ভরে দিয়ে বলল, নাও। টোটো ডাকব একটা?
তন্দ্রা মাথা নাড়ল। মৌ ফোন করল কাউকে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা টোটো এসে দাঁড়ালো। মৌ বলল, পৌঁছে একটা ফোন কোরো আমায়।
টোটো সেইসব চেনা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে যে রাস্তার সঙ্গে ওর স্মৃতি কণায় কণায়। কী করে বাঁচবে সে?
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাইরের আলোটা জ্বালিয়েই গিয়েছিল। দরজাটায় তালা দেওয়া। চাবি ব্যাগে। কিন্তু খুলতে ইচ্ছা করছে না। এ ঘরটাকে দেখলেই দমবন্ধ লাগছে। বাইকটা বিক্রি করে দিয়েছে। ইচ্ছা করেই, তাড়াতাড়ি। যেন সতীন ছিল। সব জায়গায় ও যাবে। কেন?
তন্দ্রা ঢুকল না। হাঁটতে শুরু করল আবার। বুকটা শান্ত এখন। সেই সুখটা শিরশির করে নামছে মাথা, ঘাড় বেয়ে বুকের মধ্যে। সেই বৃদ্ধকে একা লাগছে না। রাজা লাগছে। সুখী লাগছে। তৃপ্ত লাগছে। আবার যাবে ওর দোকানে। জিজ্ঞাসা করবে, কী খেতে ভালোবাসে?
তন্দ্রা হাঁটতে হাঁটতে বড় দীঘির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কী ভাবছে, হঠাৎ পিছন থেকে এসে কেউ হাতটা টেনে ধরল। মালতীর মা। তাদের পাশের পাড়ায় থাকে। বড় বড় চোখ করে বলল, কী অঘটন ঘটাতে একটা! একটা ছেলে আছে ভাববে না? আমি না এলে…..
তন্দ্রা হাতটা ছাড়াল না। মালতীর মায়ের মুখে চোখে সুখের উদ্বেগটা পড়তে পারল। বন্দী জীবনের সুখ তো এটাই, আর কাউকে বন্দী দেখে। তন্দ্রাকে সে দুর্ভাগ্যের হাতে বন্দী দেখছে। সুখ পাচ্ছে। তন্দ্রা ভুলটা ভাঙাল না। তার বুকে শিরশিরে সুখটা খিলখিল করে হাসছে। মনে মনে বলছে, তুই মর মাগী…..