Skip to main content

 

jashore road.jpg

 

সাজিয়ে দেওয়ার পর, খেল না কিছু। বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা টোটো ধরে স্টেশানে চলে এল। মায়ের কাছে যাবে। আজ ফিরবে না শ্বশুরবাড়ি। ভয় করে।

বাবার বাড়িতেও এল না। সঙ্কোচ হয়। বন্ধুর বাড়িতে এল। দ্বিধায়। তবু সংকোচের থেকে দ্বিধা ভালো। বন্ধু স্কুলে চাকরি করে, সেখানেই গেছে। ফিরবে রাতে। ক'টা টিউশানি পড়িয়ে। বিয়ে করেনি। করবেও না। পঙ্গু বোন আছে। হোমে।

স্নান করে এসে পাতকুয়ার ধারে দাঁড়াল। বন্ধুর শাড়িই পরেছে একটা। একসঙ্গে কিনতে গিয়েছিল। কোকিল ডাকছে আমগাছে। বিরক্তিকর লাগছে। বড্ড তীক্ষ্ম। ফাল্গুন মাসটা বিষ। বিয়ে হয়েছিল। স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণা থেকে আবার স্বপ্ন দেখার ইচ্ছাটাকে ভয় অনেক অনেক বেশি। এ ফাল্গুন সেই ইচ্ছা জন্মানোর কাল ছিল একদিন। মরুক গে!

পাতকুয়ার পাড়ে বসল। বেশ বাঁধানো। রোদটা নেই তেমন আজ। দরজা খোলার আওয়াজ হল। ঢুকেই বলল, চা খেয়েছিস?

না, অপেক্ষা করছিলাম।

বেগুনি এনেছি। আমি ফ্রেশ হই তুই জলটা চাপা।

দুই কাপ চা। বাঁধানো উঠানে রাখা। ধোঁয়া উড়ছে এলোমেলো। মুড়ি রাখা একটা গামলায়। আর চারটে বেগুনি একটা থালায়।

বিদিশা কথা বলছে। চায়ের ধোঁয়া ওড়া দেখছে। আনন্দী দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গুনগুন করছে। ওদের স্কুলে বসন্তোৎসব হবে। গাইতে হবে ওকে। “বসন্ত তার গান লিখে যায় ধুলির পরে কী আদরে”... আনন্দীর গলাটা ভারী। কিন্তু ভারি মিষ্টি।

চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বিদিশা। আনন্দী গাইতে গাইতে ইশারায় বলল, কান সাবধান! মানে কিছু ঢুকে যেতে পারে।

বিদিশা আচমকা উঠে পড়ে বলল, আরে চা ঠাণ্ডা হল যে!

আনন্দী বলল, তুই কী ঘোর ভাবনায় ছিলি… তাই আর বলছিলাম না….

দু'জনে চা নিল। মুড়ি নিল। বেগুনি হাতে নিল।

তুই ছেড়ে চলে আয় বিদু….., আনন্দী বলল।

তুই ছেড়ে চলে আয় বিদু…… আসা যায় না আনু….. তুমি যেন জানো না…. ন্যাকা…

আনন্দী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়া, কড়াইশুঁটি আছে। নিয়ে আসি।

বিদিশা ঝট্‌ করে দাঁড়িয়ে, আনন্দীকে ঠেলে বসিয়ে বলল, আনছি….

বেগুনির হাতের তেলটা চাটতে চাটতে রান্নাঘরে চলে গেল। ঢুকেই বিরাট চীৎকার। আনন্দী পড়িমরি করে দৌড়িয়ে রান্নাঘরে এল। বিদিশার চোখমুখ ফ্যাকাসে। আনন্দীকে ইশারায় দেখতে বলল। একটা সাপ জানলা দিয়ে ঢুকছে। বিরাট সাইজ। গ্যাসের সিলিণ্ডারের পিছনে ঢুকে পড়ল। দাঁড়াশ!

বিদিশার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আনন্দী বলল, তুই ওঘরে গিয়ে খাটে উঠে বোস। যা….

বিদিশা নড়ল না। সাপটা সিলিন্ডার বেড় করে শুয়ে। আনন্দীর কপালে ঘাম।

বিদিশা হঠাৎ বলল, এই, ওটা যদি কোনো রাজপুত্তুর হয়… ব্যাঙ যদি হয়… সাপ হবে না কেন?

আনন্দী কিছুক্ষণ কথা খুঁজে পেল না। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ধাতুতে যে গড়া তুই….. এই কাঁদে…. সর সর…. লাঠি আছে দেখ পাতকুয়োর পাশে জবা গাছটার পাশে পাঁচিলে হেলান দেওয়া। যা দৌড়ে নিয়ে আয় গে।

বিদিশা চলে গেল। হাঁটাটা স্বাভাবিক না। ঘাবড়ে আছে। আনন্দী সাপটার দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে থাকল। এই নিয়ে বার দশেক হবে। কী যে অধিকার ওর এ বাড়িতে। আনন্দীর চোখটা ছলছল করে উঠল। এ বাড়িতে মা, বাবা, বোন…. কী সব দিন ছিল!

এই নে…, আনন্দী অপ্রস্তুত হয়ে লাঠিটা নিয়ে একটু না ভেবেই সাপটার অনেক কাছে এগিয়ে গেল। বিদিশা চমকে বলল, আরে কী করছিস…কামড়ে দেবে তো……

আরে বিষ নেই এতে….

ওরম মনে হয়…. আমারও আগে মনে হয়েছিল…. ভাই পিঁপড়েও যদি বিষ থাকে তবে এরও আছে…..

আনন্দী লাঠিটা দিয়ে মাটিতে ঠুকে ঠুকে বলছে, যা… যা…..

বিদিশা লাঠির তালে তালে রান্নাঘরের বাইরে নাচতে নাচতে গাইছে…. যা যা বেহায়া পাখি যা না…. থুড়ি…. বেহায়া সাপ যা না… অন্য কোথা যা না…. কেউ করেনি মানা……

আনন্দী বলল, দেব লাঠির বাড়ি মাথায় একটা তোর…..

বিদিশা বলল, ও যাবে না…. ও নির্ঘাৎ রাজপুত্তুর…. তোর আমার মাঝখানে রাতে শোবে…. আহা কী ঠাণ্ডা গা হবে তার…. তুই আমি মিলে গরম করতে করতেই রাত কাবার……

আনন্দী হো হো করে হেসে ফেলল…. বলল, তুই কী রে….. কিছু আটকায় না…. না…..

আনন্দী বলল, খোঁচাব?

বিদিশা ঘামতে ঘামতে এসে বলল, কোথায়?

আনন্দী বলল, অসভ্যতা করিস না বিন্নি….. দিই খুঁচিয়ে?

ইতিমধ্যে সাপটা নড়ে উঠল। দু'জনেই লাফ দিয়ে রান্নাঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো।

সাপটা ধীরে ধীরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

আনন্দী আর বিদিশা পা টিপে টিপে এসে দাঁড়িয়ে দেখল, সাপটা পাতকুয়াকে বেড় করে শুয়ে এবার।

বিদিশা রান্নাঘরে পড়ে থাকা লাঠিটা এনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই উঠানে ঠুকতে ঠুকতে বলল, যাও বাবা…. আমরা এমনিই ভালো আছি…. আমাদের ওসবের দরকার নেই….. খুব শান্তিতে আছি…. তুমি তোমার শৌর্যবীর্য আর শীতলতা নিয়ে এসো….

সাপটা চলতে শুরু করল। চলতে চলতে ড্রেন দিয়ে পাঁচিলের বাইরে রেললাইনের দিকে চলে গেল।

আনন্দী আর বিদিশা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর আনন্দী বলল, আলোগুলো জ্বালি চ।

আলো জ্বলল সারা বাড়ি। বিদিশা আর আনন্দী খাটে শুয়ে চিৎ হয়ে পাশাপাশি। পা দুটো ঝোলানো। বিদিশা বলল, চল চূর্ণীর দিকে ঘুরে আসি…. একবারে রাতে খেয়ে ফিরব।

বিদিশা কোনো উত্তর না পেয়ে আনন্দীর দিকে তাকিয়ে দেখল। আনন্দীর চোখের কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে।

বিদিশা আনন্দীকে জড়িয়ে ধরল। বলল, চ আনু…. কাঁদিস না ভর সন্ধ্যেবেলা….. চ…..

আনন্দী চোখ মুছে বলল, চ।

বিদিশা বলল, দাঁড়া…. অমনিই নাকি…. সাজুগুজু করব না একটু?

আনন্দী হাসল। বলল, তাও তো….

দু'জনে এসে বসল রাস্তার ধারে একটা গাছের নীচে বাঁধানো জায়গায়। অনেকেই বসে আছে। দারুণ হাওয়া দিচ্ছে। খুব সুন্দর একটা ফুলের গন্ধ আসছে।

বিদিশা বলল, জানিস, আমার পলাশ ভালো লাগে না…. লোকে এত ছবি দেয়…. আমার কেমন অসম্পূর্ণ লাগে ফুলটাকে…. তার চাইতে শিমুল ভালো…..

আনন্দী বলল, ওই দ্যাখ…..

বিদিশা তাকাল। আনন্দী একটা বাচ্চার দিকে ইশারা করছে। আনন্দী বলল, আমাদের ঘন্টা বাজায় যে…. তার মেয়ে… দেখ মায়ের সঙ্গে কেমন কাজ করছে…. এই বয়েসেই পাক্কা ব্যবসায়ীর মত হাবভাব দেখ…..

বিদিশা দেখল একটা বাচ্চা মেয়ে মায়ের সঙ্গে চপের দোকানে কাজ করছে। ঠোঙায় চপ ভরে দিচ্ছে। টাকা নিচ্ছে। মা চপ ভাজছে। ভাজুক। কিন্তু ওসব দেখবে নাকি এখন?

বিদিশা বলল, চ, হাঁটি আনু…..

দু'জনে হাঁটতে শুরু করল। বিদিশা বলল, কী খাবি?

আনন্দী বলল, বল।

আজ আমি খাওয়াব। বিরিয়ানি?

মাটন কিন্তু…..

ঘর অন্ধকার। মশারিটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে উঠছে। আনন্দী চিৎ হয়ে শুয়ে, বিদিশা আনন্দীর বুকে মাথা রেখে, পা দুটো দেওয়ালের দিকে শুয়ে আড়াআড়ি। জানলার আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। দু'জনেই চুপচাপ। বিদিশা গাইছে মাঝে মাঝে, কোনো গান না। সুর। কী সুর জানে না।

আনন্দী বলল, জল আনি রে… আনতে ভুলে গেছি।

বিদিশা বলল, একা যাস না। সাপটা…..

দু'জনেই নামল। আলো জ্বালল। রান্নাঘরে এসে দুটো খালি বোতল ভরতে লাগল। বাইরে থেকে মালগাড়ি যাওয়ার শব্দ আসছে। ট্রেন চলে গেল। রাতের নিস্তব্ধতায় শুধু বোতল ভরার শব্দ।

বিদিশা বলল, আমি বেশিদিন বাঁচব না…. জানিস আনু…..

আনন্দী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিল্টার থেকে জল ভরছে। বিদিশা পাশেই দাঁড়িয়ে। বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল, যা না…. পাশেই তো রেললাইন…..

বিদিশা বলল, পাগল…. সাপে কাটবে না…. কিম্বা যদি সে রাজপুত্তুর ঝোপে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকে….. কিম্বা তোর জন্য…..

জল ভরা হল। দু'জনে শোয়ার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে। ঘরে পাখাটা চলছে। চারদিক নিস্তব্ধ।

বিদিশা বারান্দার দরজাটা খুলে উঠানে নেমে বলল, আয়…..

আনন্দী নামল। বিদিশা বসে। আনন্দী ওর কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে, কোমরটা জড়িয়ে সারাটা শরীর কাঁপিয়ে কয়েকবার ফুঁপিয়ে উঠল। বিদিশা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিদিশার দুই চোখে শান্ত অভ্যস্ত জলের ধারা। পাঁচিলের ওধারে, রেলের জমিতে দাঁড়ানো একটা বিরাট শিরীষ গাছ, তার চাঁদোয়ার মত ডালপালা দিয়ে, তারা ভরা আকাশ ব্যজন করতে করতে বলছে, কাঁদ, কাঁদ বিদিশা তুইও কাঁদ। রাতে একা কাঁদবে বলেই তো মানুষ হয়ে জন্মানো।