Skip to main content

 

তার জন্য ভেবো না। সব শোক ভাসিয়ে দাও। মৃত্যু অমোঘ। হৃদয় অমর নয়।

কাঁধের উপর বসে একটা কাঠবেড়ালি। নিশিকান্ত চোখ বুজে আরামকেদারায় বসে। মাঝে মাঝে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ঠুকে ঠুকে গান গাইছে। কীর্তনের সুর। বাড়ি থেকে কিছুদূরে একটা মাঠ আছে। লোকে বলে রেলের মাঠ। নিশিকান্ত মাঠের নাম দেয় না। সে বলে মাঠে যে খেলে মাঠ তার।

দাদু, মা বলল তুমি কি স্নানে যাবে না?

নিশিকান্ত চোখ মেলে চাইলো। দিনের আলোয় চোখটা জ্বলে উঠে আবার শান্ত হল। নাতি দাঁড়িয়ে। বয়স তেরো। রোগা, কালো ছেলেটার চোখের মধ্যে কী যে বিষণ্ণতা। বাবাহারা ছেলে। ব্যথা তো ওর ভাগ্যে। ভাগ্যকে কি কেউ ঠেকাতে পারে?

যা বাবা, আমি আজ পুকুরে স্নানে যাব। মাকে বল সে যেন তোলা জলে নেয়ে নেয়। আমি এই এখুনি যাচ্ছি। যা যা।

=======

নিশিকান্ত কাঠবেড়ালিটাকে গাছে রেখে একাই এসে বসেছে পুকুরের ধারে। কার্তিকে হালকা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছে খালি গায়ে। সরষের তেল অল্প অল্প হাতে নিয়ে নিশিকান্ত হাতে, বুকে, পেটে মাখছে আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। তার এক এক সময় মনে হয় ছেলে তাকে দেখছে। বউ তাকে দেখছে। এই যে রোদ গায়ে এসে পড়েছে, এ যেন ওদের দৃষ্টি। রাতের বেলা ছাদে শুয়ে শুয়ে ভাবে এই যে অন্ধকার তাকে মেখে আছে, সেও যেন তাদের দৃষ্টি।

দাদু, তোমার এই হাওয়া লাগিয়ে স্নান করা ঠিক? জ্বরে পড়বে না?

কুসুম। অল্পবয়সে বিধবা হল। বিয়ে করল না কেউ। ওর নক্ষত্রে দোষ। যে বিয়ে করবে সে-ই মরবে। কিন্তু সে তো সামাজিক বিধান। সমাজের বাইরেও তো মানুষের অনেকটা বেঁচে থাকে। সে এসে সমাজের মানুষকে সমাজের বাইরে ডেকে নিয়ে যায়। তাকে নষ্ট করে সমাজের দরজায় আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়। সবাই ফিরতে পারে না। কুসুমের জন্য কম হাতছানি আসেনি। একদিন মেয়েটা হাল ছেড়েছে।

মানুষ কেন পালিয়ে যায় না? সব ছেড়েছুড়ে পালাবে ভাবে। কিন্তু অবশেষে পালায় না কেন মানুষ? নিশিকান্তও তো পালাতে চায়। কিন্তু পালায় না কেন?

কুসুমের এখন অনেক আড় ভেঙে গেছে। সে তেল মাখতে মাখতে হিন্দি গান গাইছে।

আগে রত্না আর কুসুমের বেশ ভাব ছিল। তাদের বাড়িও আসত কুসুম। রত্না নিশিকান্তর ছেলের বউ। এখন রত্না পছন্দ করে না কুসুমের আসা। ছেলেটার নাকি ক্ষতি হবে। নিশিকান্ত সুকান্তের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। ওর ক্ষতি হলেই বরং ভালো। বড় নির্জীব নাতিটা। মায়ের আঁচলধরা। কী হবে ওর?

কুসুম জলে নেমেছে। সাঁতার কাটছে। নিশিকান্ত চোখ বন্ধ করে সোজা টানটান বসে। বন্ধ পাতার উপর সূর্যের আলো এসে পড়েছে। মনের এক দিকে কুসুমের সাঁতারের আওয়াজ, ভিজে শরীরে বাসন্তী ঢেউ। অন্যদিকে উদাসীন এক মন। বলে, অপেক্ষা করো নিশিকান্ত, অপেক্ষা করো। সব ভেঙচুরে যাবে। সব ভেঙে দেব আমি। এ খেলা, এ সুখদুঃখ সব ভেঙে দেব। তুমি মরবে। আমি আসব তোমাকে নিতে। মৃত্যু যেন কাঠবেড়ালির মত, নিঃশব্দে আসে।

======

নিশিকান্ত যখন চোখ খুলল তখন গোটা পুকুরের সামনে একা সে। তার দিগন্তযামী দৃষ্টিতে কেউ ধরা পড়ল না। গ্রামে আজকাল থাকে ক'জন? তাছাড়া এদিকে আসেও লোকজন কম।

কোমরজলে এসে দাঁড়িয়ে নিশিকান্ত। মাথার উপর চিল উড়ছে। পশ্চিমদিকে কাশের বন। পুবদিকে তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা। দক্ষিণে বাঁশঝাড়। উত্তরে মাঠ।

দাদু, তাড়াতাড়ি এসো….মায়ের ওইটা আবার হয়েছে….

নাতি তাকে ঠাকুর্দা বলে না। দাদু ডাকে। মায়ের ওইটা হয়েছে মানে আবার মৃগীর আক্রমণ হয়েছে। নিশিকান্ত গিয়ে কী করবে? সে চীৎকার করে বলল, কুসুমরে নিয়ে যা….আমি পরে আসছি……

সুকান্ত মিলিয়ে গেল। নিশিকান্ত ডুব দিল। উঠল। আবার ডুব দিল। আবার উঠল। ডুব দিয়ে শ্বাস আটকে আগে অনেকক্ষণ থাকতে পারত। এখন দমে কুলায় না। কিন্তু এবার উঠতে হবে।

======

নিশিকান্ত বাড়ির সামনে যখন এলো তখন দেখে অনেক লোক জমে গিয়েছে। মৃগী দেখার মত তো একটা কিছু নিশ্চয়ই, আর গ্রামে যেখানে আজকাল প্রায় কিছুই হয় না। লোকে মৃগী তো ছাড়, ঝগড়া, মারামারি, মৃত্যুসাজ সব খুঁটিয়ে দেখে।

নিশিকান্ত ভেজা গায়ে বারান্দায় বসল। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে রত্না বসে। শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। আঁচলটা কোলের উপর লুটিয়ে। চুলগুলো ভিজে, বাঁ কাঁধের দিকে খুলে মেলা, কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে ঝর্ণার মত। মুখ কাঁধ সব ভিজে। কুসুম একটা কাঁসার বাটিতে দুধ খাওয়াচ্ছে। দুধ তো তার বাড়ি আসে না। তবে? নিশিকান্তের জিভে দুধের সরের জন্য হাপিত্যেশ জন্মালো। নিজেকে সামলে বলল, বৌমা কেমন এখন?

রত্না তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ছেলেটা ভেসে যাবে বাবা……সব ভেসে যাবে…..পরক্ষণেই হঠাৎ উগ্র হয়ে উঠল…..বলল, তোর জন্যেই শালা সব গেল আমার….তোর অনাচারে….গ্রামের কোন মেয়েমানুষটার সঙ্গে শুসনি তুই?.......সব জানি আমি…..ছেলেটাকে খেয়ে আমাকেও ভোগ করতে চেয়েছিলিস তুই….আমি বলেই টিকে গেলাম….

এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। পাড়ার লোক হাসে। কুসুম রত্নার মুখ চেপে ধরে বলল, কী বলছিস কাকে তুই…..কী রে? স্বামী তো আমারও গেছে, তাই বলে এমন করবি….নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে শিখতে হবে না……

এবার কুসুমের পালা। রত্না মুখে যা আসল বেশ্যা, রেণ্ডি, বারোভাতারি থেকে শুরু করে আরো অকথ্য সব গালাগাল দিয়ে গেল। কুসুমের চোখ জলে ভরে এলো। সে ধীরে ধীরে দুধের বাটিটা রত্নার পাশে রেখে, “খেয়ে নিস” বলে বেরিয়ে গেল।

একে একে সবাই চলে গেল। রত্না ঘুমাচ্ছে বারান্দায়। পাশে ছেলেটাও মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রান্না কিছু নেই। স্নান করে এলে খিদেতে প্রাণ টাটায়। মাথায় আগুন ছুটে যায় নিশিকান্তর। আরামাকেদারায় বসে ছেলে আর মায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে মাথাটা চড়ে যাচ্ছে রাগে। কী কালসাপ পুষছে সে? জমিজায়গা যেটুকু আছে সেটুকু দিয়েই তো সংসার। তাও এইসব শুনতে হবে এত অনাচার সহ্য করতে হবে?

======

কম বয়েস হলে হয় তো ফাঁসি হত। কিন্তু যাবজ্জীবন কারাবাস দিল জজ নিশিকান্তকে। তার কোনো অনুতাপ হয় না? অমন জলজ্যান্ত দুটো মানুষকে কুপিয়ে মারল। তাও না?

হয় না অনুতাপ। অন্তত ওই দুটো হত্যার জন্যে তো নয়ই। অনুতাপ হয় নিজের জীবনটাকে এত ছোটো গণ্ডির মধ্যে কেন বেঁধে রাখল ভেবে। কেন পালালো না? মানুষ কেন পালিয়ে যায় না? জেলে বসে বাকি জীবনটা এটা ভেবেই কাটিয়ে দিল নিশিকান্ত। যেদিন মারা গেল, সেদিন দুপুরে খায়নি। জেলের পাঁচিলের উপর একটা কাঠবেড়ালি দেখে কেঁদেছিল নাকি অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। পাশের কয়েদিরা বলেছে। ওই একটা দিনই কাঁদতে দেখেছিল সবাই তাকে। কিন্তু কেন কার জন্য কাঁদল, কেউ জিজ্ঞাসা করেও জানতে পারেনি।