Skip to main content

 

রতন এই বিকেলেই দোকান খোলে। সাইকেল সারানোর দোকান। রতনের বয়েস হল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। ঘরে দ্বিতীয় পক্ষের পরিবার। বয়েস তার এই আশ্বিনে সাতাশ হবে। আগের পক্ষের ছেলেটা মুম্বাইতে থাকে। সোনার কাজ শেখে।

রতন এই সময়টা দোকানে এসে মহানাম সঙ্কীর্তন চালায়। সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যে চলে। রাত সাড়ে ন'টায় বন্ধ হয়। রতন বাড়ি ফেরে দোকান বন্ধ করে। কখনও দেশীমদের বোতল নিয়ে। কখনও এমনিই।

বিকাশ মাষ্টারের বউ এই গোধূলিতেই রাস্তায় হাঁটতে বেরোয়। বেশিদূর যায় না। এই পাড়ারই এ মাথা থেকে সে মাথা। ছিপছিপে গড়ন। বয়েস এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। পাড়ায় বেশি কথা বলে না। মাষ্টার রাগ করে। বিকাশ স্কুল থেকে ফিরে টিউশান পড়াতে বেরোয়। ফেরে সেই এগারোটা। ছেলেটা ছিল, কিন্তু সেও তো হস্টেলে এখন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ছেলেটা থাকলে ওর সঙ্গে লুডো খেলে বিকেলটা কেটে যেত। কখনো এটা সেটা রান্না করত। ছেলের বায়না ছিল তো। খেতে ভালোবাসত। মাষ্টারের কোনো বায়না নেই। কোনো খিদে নেই। ডাক্তার বলেছে মাষ্টারের কী যেন রোগ। ওর বাড়ির লোক বলে ও মহাদেবের অংশ। বিশেষ করে ওর বোন। বলে, বৌদি তুমি দাদার কাছে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত ব্যবহার আশা কোরো না। ও তো বিয়ে করতই না। মায়ের পীড়াপীড়ি ছিল… তাই। পাড়ায় কেউ কেউ অন্য কথা বলে। ভালো না সে কথা। পুরুষের বুকে পুরুষের জন্য হাহাকার লাগে? ওসব মিথ্যা কথা। তার বুকে তো….

বিকাশের বউয়ের নাম বিয়ের আগে ছিল ময়না। বিয়ের পর পাড়ায় হল, বকুল। তার শাশুড়ি রাখল। বলল, ও বাড়ি ভুলে যাও। ভুলতে বেগ পেতে হল না। বাবা আগেই মরেছিল। বিয়ের দু বছর ঘুরতে না ঘুরতে মা মরল ক্যান্সারে। দাদারা দায়সারা সম্পর্ক রাখল কদিন। তারপর সব গেল।

বকুল হাঁটতে হাঁটতে নীল দোতলা বাড়িটার একতলার জানলাটার দিকে তাকায়। ছেলেটা জানলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ওর স্মৃতিশক্তি সব হারিয়েছে। মা বাবা দুজনেই বড় পোস্টে কাজ করে। রাতে ফেরে। এক মাঝবয়েসী মহিলা দেখাশোনা করে। সে মহিলা বকুলকে ভালোবাসে। কখনও সে-ই তাকে ময়না বলে ডাকে। কয়েকবার ঘরেও ডেকেছে। বকুল যায়নি। হাজার স্মৃতি যাক, কিন্তু পুরুষ তো, সে স্মৃতি তো আর যাবে না! তবে?

কিন্তু বকুলের চোখ ওই জানলায় ভাসা দুটো চোখের উপর বারবার ফড়িং এর মত বসে। আবার উড়ে যায়। আবার বসে। কপালে ঘাম হয়। তলপেটের পেশি, থাইয়ের পেশিতে খামচা লাগে। বুকে চাপ চাপ ব্যথা হয়। শ্বাস ফোলে।

পাড়ায় আরো তো জানলা আছে। ক'টা জানলা পরেই পরমা বসে থাকে। কোমর ভেঙেছিল। ডাক্তার বলেছে যতটা ঠিক করা গেছে এর বেশি হবে না। পরমা মেনে নিয়েছে। পরমার ছেলে মেনে নিয়েছে। বউমা মানতে পারেনি। এ ঘরটা তার ছেলের পড়ার ঘর হোক, এই ইচ্ছা। ছেলেটা ঠাকুমার সঙ্গে বিছানা ভাগ করে নেয়, রাতের আলো ভাগ করে নেয়। রাতের অন্ধকার ভাগ করে নেয়। কী হত একাই যদি পেত?

পরমা বকুলকে দেখে। অরিজিতকে দেখে। কী সুন্দর ছেলে ছিল। কী জ্বর হল। সব ভুলল। মা বাবার টাকা অঢেল তাই বেঁচে গেল। পরমা বকুলের সঙ্গে আগে কথা বলত। কিন্তু মেয়েটা কথা বলে না। ওর ওই হিজড়ে বরের জন্যেই বলে না। মেয়েমানুষের বাড়া একটা।

আগে বকুলকে দেখলে মায়া লাগত। এখন বিরক্ত লাগে। পাড়ায় অনেকের এখন ওকে দেখলে বিরক্ত লাগে। ওর চলন বদলেছে। ওর চাহনি বদলেছে। ওর পোশাক বদলেছে। এতটা পরিবর্তন হয়?

রতনের মনটা আজকাল ভালো থাকে না। আগে বিকেলটা ভরে থাকত সুখে। বকুলের সুখে। যেন শ্রীবৃন্দাবন হয়ে যেত পাড়াটা। সে এদিক ওদিক হাঁটত। এখন….যেন সোনাগাছি। ছি রে! মহানামে সে মাধুরী নেই। রাতে ঘুমে সে সুখ নেই। জাগায় সে স্বস্তি নেই। কী যেন হারিয়ে গেল। কী? বকুল? চাইল কবে সে? মনের ক'টা ফাঁক বোজায়?

সেদিন পাড়ায় শীতলা পুজো। পরমা জানলার ধারে বসে। নতুন শাড়ি পরেছে। রতন সেদিন দোকানের চারদিকটা পরিষ্কার করিয়েছে। এ পাড়ায় এটাই সব চাইতে বড় পুজো। অনেক লোক আসে। মেলা বসে।

মাইক বাজছে। রতন অপেক্ষা করছে। পরমা চা নিয়ে বসে। অপেক্ষা করছে।

বকুল বেরোলো। একটা নীল শাড়ি পরেছে। মিলিয়ে কানের দুল। হার। অরিজিৎ জানলায় ধারে নেই। রতন হাসল। পরমা বলল, বৌমা পাঁপড় ভেজে দাও তো। আর চা-টা আরেকবার গরম করে দাও।

মিনিট পনেরো পর রতন দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, বৌদি, স্যার আজকেও পড়াতে গেছে?

বকুল হাসল।

পরমা বলল, মা তুমি কী রোগা হয়ে গেছ….শাড়িটা কোত্থেকে নিলে?

বকুল হাসল। মাইকের শব্দের ঢালে চলে গেল উত্তর দেওয়ার ব্যর্থ অভিনয়ে। পরমা বুঝল। অরিজিতের জানলার দিকে তাকালো। নেই। অপমানটা হজম হল।

হঠাৎ অরিজিতের বাড়ির দরজাটা খুলল। পৌলমী, যে অরিজিতের দেখাশোনা করে, সে ডাকল….বকুল…অ্যাই বকুল…..

বকুল দৌড়াতে দৌড়াতে এলো।

পৌলমী বলল, ছেলেটা ট্রেন থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়েছে….আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে….আমি কাকে বলব…তুমি একটু বসবে?….ওর মা রওনা দিয়ে দিয়েছে। দেড় ঘন্টায় ঢুকে যাবে।

বকুল হ্যাঁ না কিছু না বলে ঘরে ঢুকে এল। বসার ঘরে বসল। এরা অনেক বড়লোক। শুনেছে। কী সাজানো ঘর! পাশের ঘরে অরিজিৎ। ওর নাকি জ্বর। সকাল থেকে।

পৌলমী বলল, তুমি ওর পাশে একটু বসবে ভাই, আমি পরিচয়টা করিয়ে দিয়ে যাই।

পরিচয়? শব্দটা বিঁধল। তার কী বাকি আছে? বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। ঘাম হচ্ছে। লুকাবে না। কত লুকায় মানুষ?

খাটের পাশে বসল। অরিজিত তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।

পৌলমী অরিজিতের হাতটা নিয়ে বকুলের হাতের উপর দিয়ে বলল, এই যে….তোমার এক দিদি….

অরিজিতের উষ্ণ হাতটা বকুলের ঘর্মাক্ত হাতের উপর রাখল পৌলমী। বলল, ও চোখে দেখে না বকুল স্পষ্ট… সামনের জিনিসই আবছা দেখে….আর দূরের জিনিস তো শুধু অবয়ব….ও শুধু ছোঁয়াটা আর গলার আওয়াজটা চেনে।।

বকুলের সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি বাইরের ঘরে বসি….উনি রাগ করতে পারেন….একটা ফোন করে ওঁর অনুমতি নিয়ে নিই……

ছেলেটাকে একা রেখেই বকুল সারটা ক্ষণ ওদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। পৌলমী কাজের কাপড়টা পরেই দৌড়ালো, ছাড়ল না। পরমা জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। পাঁপড় চা কিছুই মুখে দেয়নি। রতন দোকান বন্ধ করে চলে গেছে আগেই। কী একটা কাজ পড়েছে। যাওয়ার সময় আজ দুটো বোতল বেশি মদ নিয়ে গেছে।

বকুলের নিজেকে নিষ্প্রাণ একখণ্ড শাড়ি জড়ানো মাংসের তাল মনে হচ্ছে। এত কাছে মৃত্যু….. তবু কেন যে এত ঘুরপথে আসে সে…..