Skip to main content

 

111.jpg
    

দাউদ হায়দার মারা গেলেন। বার্লিনে। ৭৩ বছর বয়সে। কে ছিলেন? কবি ছিলেন। কোন দেশের কবি ছিলেন? দাউদ হায়দারের কোনো দেশ ছিল না। নির্বাসিত কবি ছিলেন। জন্মেছিলেন বাংলাদেশে। এমনই বিধির বিধান, জন্মদিনটাও ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল। কবিতা লিখতে শুরু করেন অল্প বয়েস থেকেই। লণ্ডন কবিতা সোসাইটির শিরোপাও পান, মাত্র একুশ বছর বয়সে।

কিন্তু ভাগ্য ছিল বিড়ম্বিত। পরের বছর, মানে বাইশ বছর বয়সে একটা পত্রিকায় লেখেন একটা কবিতা - কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়। সে কবিতায় অনেকে রুষ্ট হলেন। কারণ - বহু ধর্মপ্রণেতার বিরুদ্ধে কলম ছিল ভীষণ রূঢ়। কবিতাটা ছিল অসম্ভব রাগ আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। জানি না ওঁর বয়েসটা যদি আরো বেশি হত তবে হয়তো ভাষা আরো অন্যরকম হত। সমাজের একটা বড় অংশের ধর্ম, রাজনীতির দ্বিচারিতাকে হয় তো অন্যভাবে প্রশ্ন করতেন। জানি না। কিন্তু বাইশ বছর বয়সে অনেক কিছুকে অনেক অবশ্যম্ভাবী মনে হয়। মানুষের কাছ থেকে আরো বেশি সততা, ইন্টিগ্রিটি, নিষ্ঠা, ভালোবাসার প্রত্যাশা থাকে। একটা স্বচ্ছ, সৎ, সংবেদনশীল সমাজের প্রতিচ্ছবি আদর্শবাদী চেতনায় থাকে, যা বাস্তবের আঙিনায় প্রতিনিয়ত মুখ থুবড়ে পড়ে। রূঢ় সমাজ তরুণ প্রাণের সে আদর্শ সমাজের স্বপ্নকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। সে তরুণ হয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ ভীষণ। তীব্র যন্ত্রণায় সমাজের প্রতিষ্ঠিত সব বিশ্বাসকে আঘাত করাই তার একমাত্র কর্তব্য বলে মনে হয়। বাস্তবটা যে তা নয় সেটা মেনে নিতে বাইশ বছরের একজন সাহসী তরুণের পক্ষে অনেকাংশেই অসম্ভব।

হায়দার পারেননি। তাই বাইশ বছর বয়সে ভারতগামী একটা উড়োজাহাজে তাঁকে চাপিয়ে দেওয়া হল। সম্বল বলতে, ষাট পয়সা, দুটো কবিতার বই, দুটো শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার একটা আর একটা টুথব্রাশ। পশ্চিমবাংলায় এলেন। তখন সেখানেও নতুন রাজনীতির হাওয়া। নীৎশে, ফুকো, দেরিদা প্রভৃতির আলোচনায় মেতে তরুণ প্রজন্ম। গোটা পৃথিবীর সব প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণা ভেঙে তারা এক নতুন সমাজের পুনর্নির্মাণ করবেন, এমন কল্পনা। সেখানে ধর্ম থাকবে না, সেখানে মানুষে মানুষে অসাম্য থাকবে না জাতপাত, অর্থের বৈষম্য নিয়ে। সেখানে সবাই হবে স্বাধীন। মুক্তচিন্তায় সৃষ্টি হবে নতুন প্রজন্ম।

আবারও স্বপ্ন ভাঙল নির্বাসিত কবি হায়দারের। ১৯৮৭ সাল। ভারত জানাল এবার তার এখানে থাকার মেয়াদও শেষ। আদর্শ আবার বাস্তবের সামনে মাথা ঝুঁকে দাঁড়ালো। গুন্টার গ্রাস তখন এদেশে। তিনি ব্যবস্থা করলেন হায়দারকে জার্মানে নিয়ে যাওয়ার। এবং দেশহীন কবি আশ্রয় পেলেন প্রবাসে। কিন্তু মন পড়ে থাকল বাংলাদেশের মাটি, জল আকাশে বাতাসে। এসবের তো কোনো ধর্ম হয় না। মাটি, জল, বাতাস এরা ভাগ্যে তাদের স্রষ্টা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই তারা আত্মপরের ভেদও করতে জানে না।

হায়দার মারা গেলেন। হায়দার দেশে ফিরতে পারবেন না জানতেন। কিন্তু তবু স্বপ্ন দেখতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিতর্কিত কবিতাটার কয়েকটা ভাষাকে সমর্থন করি না। ভাবকে তীক্ষ্ম, ক্ষুব্ধ হতে গেলে ভাষাকে রূঢ়, আক্রমণাত্মক হতে হবে এ আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ওঁর বয়েসটা তো অতটা গভীর ছিল না। কিন্তু, পারতেন না তখনকার সমাজের অভিভাবকেরা আরেকটু ধৈর্য ধরতে? আরেকটু সহনশীল হতে?

কিন্তু ইতিহাসে এ তালিকা তো দীর্ঘ। দান্তে, মিল্টন, ভোল্টায়ার, স্পিনোজা থেকে নেরুদা, বরিস পাস্তারনাক, আলেকজাণ্ডার সোলঝিনিৎসিন, থমাস মান প্রমুখ হয়ে হায়দার, নাসরিন, রুশদি অবধি। সবাই কোনো না কোনোভাবে নির্বাসিত। কারণ কোথাও ধর্ম, কোথাও রাজনীতি। আসলে ধর্ম আর রাজনীতি তো অজুহাত। মানুষ গোষ্ঠীভোগী জীব। সে গোষ্ঠী কখনও ধর্মের দড়িতে, কখনও রাজনীতির দড়িতে আমরা-তোমরা বা আমরা-তুমিতে বিভক্ত। সব মুখোশের আড়ালে তো গোষ্ঠীজীবী মানুষই শেষ কথা। স্বর্গে আর পাতাল তো এ মাটির গন্ধেই সৃষ্টি। মানুষ গোষ্ঠীর চাদরে নিজেকে ঢেকে নিয়ে ভাবে সব ঠিক আছে। হয় তো একটা গোষ্ঠীতে পৃথিবীর কয়েকটা আবর্তনে সব ঠিক থাকে। কিন্তু উদাসীন এ পৃথিবীর নিজস্ব কিছু উসুল তো আছেই। বড় নিষ্ঠুর সে। সব কিছুকে সরিয়ে একমুঠো ধুলো করে দেয়। ক্ষমতাশালী একদিন ক্ষমতাহীন হয়। কিন্তু কবিতার ব্যথা পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে অসীমের সঙ্গে মিশে থাকে, কোনো এক দরদীর প্রাণে বাজবে বলে। সত্য তো চিরকালই নির্বাসিত, তাই কবিও, আর তার কবিতারাও।