ঠাকুরমশায় যখন মন্দিরে এলেন, তখন অন্ধকার বিন্দু বিন্দু আকাশ চুঁইয়ে ঘাসে পড়ছে। জৈষ্ঠ্যের আকাশ, আষাঢ়ের মেঘ ডেকে এনেছে। ঠাকুরমশায় মন্দিরের দরজা খুলে বাইরে তাকালেন। মনে পড়ল স্ত্রীর কথা। ঘন কালো চুলের রাশ তার কালো ঘাড়ে যে অন্ধকার নামিয়ে আনে, গোটা প্রকৃতি জুড়ে যেন সেই অন্ধকার। ঠাকুরমশায় প্রদীপ জ্বাললেন। বৃষ্টি নামল আকাশের ঢাল বেয়ে ঝমঝমিয়ে। শ্রীরাধাগোবিন্দ মন্দির। বহু পুরোনো মন্দির। প্রতিমার সাজসজ্জা নেই। তবু শ্রীরাধার কানের সেই পুরোনো কানের দুল প্রদীপের আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল। ঠাকুরমশায়ের মনে এল তার স্ত্রীর কানের দুটো দুলের কথা। কেউ বলেছিল, “ঠাকুরমশায়, ওটা খুলে নিন, আগুনে দেবেন না। ও সোনার, আপনার সম্বল। যে গেল, সে তো গেলই”। ঠাকুরমশায় পঞ্চপ্রদীপে আরতি করছেন। ঘন্টা নাড়তে পারেন না। হাত টাটায়। শাঁখ বাজানোর কেউ নেই। পঞ্চপ্রদীপের আলোর দিকে তাকিয়ে শ্রীরাধা। দুটো প্রাচীন চোখে কী দিগন্তলীন ভালোবাসা। মৃত্যু কই? যে গেল, সে কী একেবারেই গেল? কেউ কী একেবারেই যেতে পারে? প্রদীপ নিভে গেল। ভোরের আলোয় স্ত্রীকে যতবার দেখেছে, বিস্মিত হয়েছে। তার ঘুমন্ত মুখের মধ্যে কীসের যেন আশ্বাস। তার ঘুমন্ত আঙুলের মধ্যে নিজের জেগে যাওয়া আঙুলগুলো প্রবেশ করিয়ে বলেছে, ছেড়ে যেও না। যায়নি। এই ঘন অন্ধকারে প্রতিটা শ্বাস বলছে, সে যায়নি। যদি যেত তবে এতবড় শূন্যতাকে ধরে রাখত কোন বিশ্বাস? সব শূন্যতার একটা পরিধি আছে। যাকে অসীমে মেলাতে গেলে কেন্দ্রে জাগে ব্যথা। যে ব্যথা বলে, সে আছে, আছে, সবটুকুই আছে।