Skip to main content

 

জ্ঞান আছে। শান্তি নেই। রামপ্রসাদ সেন গাইছেন, “জ্ঞানসমুদ্র মাঝে রে শান্তিরূপা মুক্তা ফলে” কী ভাবে পাওয়া যাবে? না, শিবযুক্তি মত চাইলে। জ্ঞানসমুদ্রে যদি মঙ্গলের অন্বেষণ না থাকে তবে সব বৃথা। মঙ্গলের ইচ্ছা আর জ্ঞানের শক্তি, এতেই শান্তি।

রবীন্দ্রনাথ ‘'লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখছেন, কাউকে সর্বশ্রেষ্ঠ অপমান করার উপায় হল তার উপকার করা অথচ তাকে প্রীতি না করা। রামপ্রসাদের গানেও সেই, ভক্তিতে মঙ্গলের শিখা। সে শিখার আলোয় জ্ঞানসমুদ্রে শান্তির পথের দিশা। কিন্তু ভক্তি কী? ভক্তির সক্রিয় দিক দরদ। দরদী না হলে শান্তি কই? নেই। নিজেকে নিয়ে যত ব্যস্ত হচ্ছি তত ফাঁসছি। কী এক অনন্ত ভুলভুলাইয়া। যেন নিজের খুব উপকার করছি। হচ্ছে লবডঙ্কা। শুধু টেনশান আর অ্যাংক্সাইটি। “যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ, তাহে ভেবে মরি, তাহে কেঁদে মরি”। কেঁদেই যাচ্ছি আর ভেবেই যাচ্ছি। ভাবছি একটা দাগ অবধি পৌঁছে গেলেই নিজেকে নিয়ে শান্তিতে ঘর করব। কিন্তু দৌড়িয়েই যাচ্ছি, দৌড়িয়েই যাচ্ছি, দাগের পর দাগ পেরিয়েও যাচ্ছে, কিন্তু শান্তি কই? নেই নেই নেই। কারণ? ওই যে, না আছে দরদ না আছে শিবযুক্তি আছে। জ্ঞানসমুদ্রেও গরল জন্মাচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চুঁইয়ে ঢুকছে জ্ঞানসমুদ্রের গরল। অশিব-যুক্তি আর অদরদী হামবড়া ‘আমি’ সর্বস্ব মন্থনে।

প্রসাদ আরো গাইছেন, “কামাদি ছয় রিপু আছে আহার লোভে সদাই ঘোরে, তুমি বিবেকহলদি গায় মেখে নাও, ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে।”

বিবেক বড় মাগ্যি আজকাল। মশায় এই ইনস্টার যুগে বিবেকের কথা পাড়ো? বড্ড সেকেলে ভাবনা তো হে তোমার? যেখানে সোশ্যালমিডিয়ায় চোদ্দো-পনেরো থেকে ষাট-সত্তর বয়সী সমাজের একটা বড় অংশ পুরুষ-নারী, কিশোর-কিশোরী প্রায় নিরাবরণ হয়ে আদিরসে বন্যা তুলে দিচ্ছে, সেখানে এসব কথার মানে কী দাদা? মানলাম আপনি নেটফ্লিক্সে ‘'অ্যাডালেসেন্স’ দেখেছেন। কী আছে সেখানে? তেরো বছরের বাচ্চা ছেলের ছুরির আঘাতে আহত বান্ধবী, এবং ঘটনাক্রমে সে আঘাতে মৃত্যু। বাচ্চা ছেলের মনের অন্ধকার দিক। নারীবিদ্বেষ বা নারী-এলেবেলে বা নারী-দুচ্ছাই এরকম নানা ইন্টারনেট জগতের গ্রুপের সঙ্গে সে বাচ্চা ছেলের জ্ঞান ও পরিচিত। সরল, অবোধ বালকের এমন সব মানসিক প্রবৃত্তির পরিচয় পেয়ে মনোবিদের ভিরমি খাওয়া। এই নিয়ে তো প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। ইনস্টাগ্রামে কীভাবে নানা ইমোজি নানা গুপ্ত সংকেত বহন করে, সে সব বালক মনে কী প্রভাব ফেলে, এইসব নিয়ে আলোকপাত আছে তো! কিন্তু কী হল? সব অভিভাবক বুঝি এখন থেকে স্পাইং করবেন? ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলবেন? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করবেন? করতেই পারেন। কিন্তু সে গুড়েবালি। আপনি একটা রাস্তা বন্ধ করবেন, সে আরো দশটা খুলবে। মানুষের প্রবৃত্তির যে জোয়ার যখন আসে তাকে কী আর আটকানো যায় রে বাবা? তাও আমাদের মত চুনোপুঁটিদের? আমরা সোশ্যালমিডিয়ার মস্তিষ্ক বিষক্রিয়া থেকে সোশ্যালমিডিয়ার বেলেল্লাপনা আর তার প্রভাব শিশুমনে সব জানি। মায় প্রবন্ধ লিখে দিতে পারি। কিন্তু ঠেকাব কী করে? আমি নিজেও তো…..খ্যাক.. খ্যাক…খ্যাক….থাক এসব কথা।

আচ্ছা রামপ্রাসাদের গান নিয়ে কপচাচ্ছিলাম না? হঠাৎ এদিকে কী করতে এলাম? যা হোক। তো প্রসাদ কবি যা বলছেন, “ধৈর্য খোঁটায় বেঁধে থুবি”, আর তারপর আরো বেয়াড়াপনা করলে “জ্ঞান খড়গে বলি দিবি”। কাকে? ওই যে রিপুগুলোকে। ক্যাটকেটে লোভ আরা টকটকে অহো অহো…হাম হাম….আমিকে। জ্ঞান খড়গে বলি। মানে ধুপিয়ে কাচা। ওসব বলি-টলি শব্দ আজকাল আবার কেমন যেন। “দিনের কাজে ধুলোলাগি, অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার/ আমার এই মলিন অহংকার…..এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে…..”।

শান্তি শান্তি শান্তি। একটু বসার জায়গা। একটু জুড়োবার হাওয়া। একটু ডুব দে রে মন ঘুমসায়রে, বলে ঘুমে ডোবা। একটু বিনা তাপে কাছাকাছি আসা। একটু বিনা ঘর্ষণে কথা বলা। একটু বিনা সূঁচ, কাঁটা বিঁধাবিঁধি ছেড়ে পাশে বসা; পাশাপাশি হাঁটা। একটু বিনা ক্ষোভ, বিনা শোক একা একা হাঁটা। একা একা গান গাওয়া। এই তো। দু দণ্ড হেঁটে, দু দণ্ড দাঁড়িয়ে চলা আর থামা।

প্রসাদ মাকে ভালোবেসেছিলেন। আমার তো জগদম্বা নাই। আমার তো মত আছে। ইজম আছে। বিচার আছে। সংশয় আছে। আমার কী হবে? উপায় নেই? আছে। প্রসাদের যে মা, সে তো প্রসাদের হৃদয় বই কেউ নয়। রবিঠাকুরের যে তিনি, সেও তো তার হৃদয় বই কেউ নয়। যে যার আত্যন্তিক প্রেম, সে তো তার হৃদয়েরই আরেক নাম। আমার আর কিছু না থাক, হৃদয় তো আছে। আর হৃদয় যতক্ষণ আছে ততক্ষণ শান্তির রজ্জুতে গাঁথা সুখের ফুলের মালা চাওয়ার ইচ্ছাও আছে। শান্তি কী পথের শেষে? শান্তি তো পথের দুই ধারে। শিবযুক্তি আর সহযাত্রীর সঙ্গে দুটো দরদী কথায়। প্রসাদ গাইছেন, “দেহের মধ্যে ছজন কুজন তাদের ঘরে দূর করেছি/ রামপ্রসাদ বলে দুর্গা বলে যাত্রা করে বসে আছি”।

দুটো স্টেশান যাওয়ার হলেও মাকে প্রণাম করে, মায়ের শাড়ির গন্ধ মাথায় মেখে যখন দাঁড়াতাম, মা বলতেন, এসো, দুর্গা দুর্গা। সেখানে এতবড় জীবন যাত্রা, এখানে কেউ দুর্গা দুর্গা বলে যাত্রা শুরু করিয়ে দেবে না? এ দুর্গা পুরাণের ততটা না, যতটা মায়ের হৃদয়ের দরদের। মায়ের হৃদয় চেনে না এমন হৃদয় নিয়ে পশুও জন্মায় না, তো মানুষের কী কথা! তাই না? ওই তো শুরুর দাগ। তারপর? ওকে সম্বল করে এগোলেই হয়। সোয়া ঘন্টার পথ তো। কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রাণাঘাট, তিব্বত, ব্যস! সওয়া ঘন্টার পথ। গেলেই হল। জয় মা!