আমি বিশ্বাস করি না রেগে গেলেই মানুষ "আসল কথাটা" বলে ফেলে। কিম্বা রেগে গিয়ে সে যা বলে সেটাই তার "আসল" পরিচয়। এটা নয়। রাগের মাথায় সে বলে সে উত্তপ্ত আবেগের বশবর্তী উত্তেজিত বুদ্ধির কথা। সেটা কখনওই তার আসল পরিচয় হতে পারে না।
কেন কথাটা বললাম, এখন তো সবাই ভীষণ তর্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। সেটাই স্বাভাবিক। এমন স্তব্ধ করে দেওয়া ঘটনায় আঘাত লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে নিউজ চ্যানেলগুলোও উস্কানি খবর দেখিয়েই যাচ্ছে। তাও যে গোটা দেশে এখনও শান্তি বজায় আছে, কয়েকটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া এই পরম ভাগ্যি।
অনেকের কাছে এত তর্ক "নয়েজ" লাগছে। একবার অনেক বছর আগে কলকাতায় মেট্রোতে এক যুবক যুবতী চুমুটুমু খেয়েছিলেন নিজেদের। আর কেউ তাদের বকেছিল না মেরেছিল এমন একটা কিছু ঘটেছিল। ব্যস, সেই নিয়ে সংস্কারবাদী, পুরাতনবাদী, নারীবাদী, মুক্তমনায় কী তক্কাতক্কি পনেরো দিন ধরে চলল। এমন তো হয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায়।
কিন্তু এবার ব্যাপারটা অনেকে বেশি সিরিয়াস। যে যাই লিখছেন, তাই সে-ই মানুষটার আসল রূপ ভেবে বসবেন না প্লিজ। অনেকেই রাগ থেকে, ক্ষোভ থেকে, আঘাত থেকে, ভুল বোঝা থেকে লিখছেন। এই ভুল বোঝাবুঝি আর বিদ্বেষ জিনিসটা ভীষণ কাছাকাছি। সে অন্য আলোচনা। কিন্তু দেখেছি কাউকে ঠিক ঠিক জানতে পারলে বিদ্বেষ জন্মায় না। করুণা হয়। তার লিমিটেশন বুঝে যেতে কোথাও "হেরে গেলাম" বোধ হয় না। একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং জন্মায়। ধরুন একটা বাচ্চা পড়ে না বলে খুব রাগেন তার উপর। একদিন তার IQ পরীক্ষা হল। দেখলেন সে ভীষণ নীচের দিকে ফলাফলে আছে। রাগ হবে না আর। এমনই আরকি।
এখন আরেকটা কথা হল আমরা সবাই সব বিষয়ে এক্সপার্ট নই। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীও নই, যে, সে ভীষণ উত্তেজনার সময়েও বিবেকবুদ্ধি হারাব না। কলম প্রায়শই বিবেকানুগামী হবে, এমন অভ্যাস আমাদের নেই।
মোদ্দাকথা এই সময়ে যে যা বলছেন লিখছেন সেটাকেই সংরক্ষণ করে, তাকে ট্যাগিয়ে দেবেন না। "এই মানু্ষটাকে এই সময়ে ভালো করে চিনে রাখুন" ইত্যাদি ইত্যাদির ফাঁদে পা দেবেন না। নিজেকেই চিনতে চিনতে বেলা গড়িয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়ল প্রায়, আর একজনের একটা কথায় তাকে গোটাগুটি চিনে ফেলব? তাই হয়? একদিন সব রাগ পড়ে যাবে। মাথা ঠাণ্ডা হলে আবার বিবেক জেগে উঠবে। আমাদের সিদ্ধান্তের উপর দেশের দশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে না। কিন্তু আমার উত্তেজনার উপর আমার স্বাস্থ্য, আমার চারপাশের পরিবেশ নির্ভর করছে। আমার বাড়ির পরিবেশ, আমার কাজের পরিবেশ ইত্যাদি।
আবারও একই কথা বলে শেষ করি, কাউকেই দাগিয়ে দেবেন না। মানুষ চেনা অত সোজা একটা কাজ না জানেনই তো। কটা কথা ছাপিয়ে মানুষ কদ্দূর চলে যায়। "কেবল মাত্র কথা রবে" এ গানের শুধু। কোন কথা? যা সে শান্ত মাথায়, সৎ উদ্দেশ্যে বলেছিল। আঘাতে, কী বিদ্বেষে অন্যকে আঘাত দেওয়ার জন্য বলা কথা যে বলে তাকেও কি শান্তি দেয়? দেয় না। সবাই অবশেষে সব ভুলতে চায়। আর চায় বলেই দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা জগতে শান্তি এসেছিল। "ক্রোধকে অক্রোধের দ্বারা জয় করবে, এই সনাতন ধর্ম" - বুদ্ধ। ভালোমন্দ মিশিয়েই মানুষ। তাই না? শুধু একদিক মনে রাখলে হয়? গুগুলের সব মনে রাখলে চলে, কারণ তাকে বাঁচতে হয় না। মানুষকে বাঁচতে হয়। সব মনে রাখলে চলে?