বুদ্ধ তৃষ্ণার কথা বললেন। অজ্ঞানতার কথা বললেন। বুদ্ধ অহিংসার কথা বললেন। করুণার কথা বললেন। বুদ্ধ বললেন, আমার প্রজ্ঞা আর করুণাকে আবৃত করে রেখেছে আমার তৃষ্ণা আর আমার অজ্ঞানতা। আমি জীবনে নানাবিধ যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছি। শারীরিক, মানসিক ও অধ্যাত্মিক। শারীরিক ক্লেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায় জীবনশৈলীতে বদল এনে। কিন্তু মানসিক ও অধ্যাত্মিক ক্লেশ কীভাবে যাবে? বুদ্ধ তৃষ্ণা আর অজ্ঞানতাকে চিনতে বলছেন। ধ্যানমগ্ন হও, আত্মমগ্ন হও, খুঁজে দেখো কোথায় তৃষ্ণা আর অজ্ঞানতা তোমাকে বিবশ, জড় করে রেখেছে। বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি। ধম্মং শরণম গচ্ছামি। সংঘম শরণং গচ্ছামি। কীভাবে?
বুদ্ধকে কেন্দ্র করে কাহিনীর পর কাহিনী তৈরি হতে শুরু করল। বুদ্ধের অনুভব পরবর্তীকালে অনুগামীদের বৌদ্ধিক জটিল বিশ্লেষণে জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করল। এত এত শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়ে গেল যে এখন মূল বুদ্ধকে আর তাঁর শিক্ষাকে খুঁজে বার করা কঠিন।
তবু বুদ্ধ করুণাবতার। ঈশ্বরহীন করুণা হয় কী করে? কৃপাহীন করুণা হয় কী করে?
বুদ্ধ বললেন, তোমার সত্তার মধ্যে আছে করুণা মিশে। বীজ আকারে। অঙ্কুরিত হলে শান্তিবৃক্ষ স্থাপিত হবে। তৃষ্ণা আর অজ্ঞানতা বীজকে আবৃত করে রেখেছে। সাধনা হবে সেই অঙ্কুরণের পথকে অনাবৃত করে।
ঘন্টা বাজল দূরে। আম্বেদকর আর চণ্ডালিকা দেবালয় থেকে, সমাজ থেকে বহুদূরে বসে। তাদের স্পর্শে পাপ জন্মাবে সমাজে। দেবতা অশুচি হবেন। ব্রাহ্মণ রক্তচক্ষুর সীমানা টেনে দিয়েছেন চণ্ডালিকা আর আম্বেদকরের জন্য।
প্রচণ্ড তাপে বাতাস হল উষ্ণ। উষ্ণ বাতাসে উঠল ঝড়। আম্বেদকর আর চণ্ডালিকা উঠে দাঁড়াল। গোটা সমাজ বে-আব্রু হয়ে যাচ্ছে ঝড়ে। দেবতার আসনে ধুলোর স্তর। ব্রাহ্মণের মস্তিষ্কে যুগান্তরের অন্ধকারে ভয় আর ঈর্ষার চামচিকে। সমাজের এদিক ওদিক পূতিগন্ধময়। সব ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। ব্রাহ্মণ দুই হাত আকাশের দিকে তুলে বলল, কী দিইনি প্রভু তোমায়? আকাশে ভেসে উঠল বুদ্ধের ছবি। বুদ্ধ বললেন, দিয়েছ অনেক কিছু, যা আমি চাইনি কোনোদিন। নাওনি আমি যা দিতে চাই।
ব্রাহ্মণ পুঁথি বার করল। বলল, এই যে অনুশাসন…. সব যে মেনেছি প্রভু!
বুদ্ধ বললন, ও শুষ্ক, নিষ্প্রাণ অক্ষরের অনুশাসন। অক্ষরের অনুশাসন যারা মানে তারা চিরকাল ধ্বংস করে নিজের অন্তরের বুদ্ধত্বকে। আমাকে।
কী চাও তবে তুমি?
বুদ্ধ বললেন, সত্য, প্রেম, করুণা।
কী দিতে চাও তুমি?
বুদ্ধ বললেন, যা নিতে চাই। সত্য, প্রেম, করুণা।
ব্রাহ্মণ হল ক্ষুব্ধ। বলল, তুমি দেবতা নও। তুমি ভ্রম। আমার দেবতা চান ভোগ। আমার দেবতা চান স্তবস্তুতি মন্ত্র। আমার দেবতা চান সমাজের বর্ণাশ্রমে বিভাজিত মানুষের অধিকারভেদ। আমার দেবতা তুমি নও।
বুদ্ধ স্মিত হাসলেন। বললেন,”ব্রাহ্মণ নও তুমি। ব্রাহ্মণ জাতিতে উৎপন্ন হলে, কিম্বা ব্রাহ্মণীগর্ভজাত হলে আমি তাকে ব্রাহ্মণ বলি না। সে যদি আসক্তিমুক্ত, পাপমুক্ত, বৈরিমুক্ত না হয়, তবে বাইরের আবরণে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না। যে নিষ্পাপ, তৃষ্ণারহিত সে-ই ব্রাহ্মণ।”
আম্বেদকর আর চণ্ডালিকা এসে দাঁড়াল ব্রাহ্মণের দুই পাশে। তাদের দুই জোড়া চোখে কীসের জ্যোতি? কীসের আলো? কোন ঝড়ের ইঙ্গিত?
ব্রাহ্মণ চীৎকার করে ডাকল, ওহে সমাজরক্ষক, দূর করে দাও এ অশুচি, নীচকুলেজাত, নিকৃষ্ট মনুষ্যদেহধারী জীবদ্বয়কে। সব হল অশুচি! হায় হায় হায়।
কেউ উত্তর করল না। চণ্ডালিকা বলল, অক্ষরের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে এসো। প্রাণের গভীরে আছে শান্তিনিকেতন। তার চারদিকে চারটে দরজা। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা। এসো। আমার হাত ধরো।
সেদিন থেকে বুদ্ধের আশীর্বাদী হস্তস্পর্শ সেই সব প্রাণের স্পন্দনে, যারা নিষ্পেষিত, শোষিত, বঞ্চিত হতে হতে শোনে প্রাণের গভীরে কার আহ্বান, হৃদয়ে হতাশায় ঢাকা কালো আকাশে কার দুটো চোখ! তারাই জাগে। গায়, বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি। ধম্মং শরণম গচ্ছামি। সঙ্ঘং শরণম গচ্ছামি।