এত সকালে মন্দিরে কেন গোঁসাই?
কাল সারারাত ঘুম এল না যে। জিজ্ঞাসা করতে এলাম, ডেকেছিলে কেন?
জগন্নাথ মন্দিরের সামনে ভক্তের ভিড়। মাহেশের জগন্নাথ প্রসিদ্ধ। কত কথা মুখে মুখে ফেরে। গোঁসাই দাঁড়ালো দূরে। নাটমন্দিরে। ডেকেছিলে কেন?
উত্তর দেয় না ঠাকুর। গোঁসাই উত্তর খোঁজে। কাল ঘুম এল না কেন? কী হয়েছিল বুকের মধ্যে? কী কথা এসেছিল মেঘের মত? মেঘ তো শুধু বর্ষায় ভেজায় না, বাজের গর্জনে চমকও লাগায়। কী হয়েছিল গো?
মন্দির বন্ধ হবে। প্রভুর ভোগ লাগবে।
গোঁসাই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে। বুকের মধ্যেও এমন কপাট। দরজা খুলবে না প্রভু? ডাকবে না ভিতরে?
দরজা খুলল। আরতি শুরু হল। গোঁসাই নাটমন্দিরে বসে। কেন ডেকেছিলে?
দুপুরটা অনাহারেই কাটল। গঙ্গার ধারে এসে বসল গোঁসাই। বুকের মধ্যে রথের চাকার গড়গড়ানি। মানুষের বুকের মধ্যে প্রভুর রথের চাকা। গড়িয়ে যাচ্ছে যুগযুগান্তর ধরে। রথের চাকা কি কোথাও বাধল প্রভু? আটকাতে চাইলাম কি? বুকের মধ্যে গতি না থাকলে বিষাদ জমে। বোঝা যায় রথের যাত্রাপথ থেকে দূরে এসে পড়েছি। ব্যর্থ হয় দিনরাত।
গোঁসাই…. এসো… মন্দিরের দরজা খুলেছে আবার….
গোঁসাই এসে দাঁড়ালো নাটমন্দিরে আবার। রথ গড়াচ্ছে আবার বুকের মধ্যে। মহাকাশ জুড়ে অজস্র গ্রহনক্ষত্রে যেমন প্রভুর গতি, অনন্তকাল জুড়ে অনন্তলোকে। তেমন এ বুকের মধ্যে সুখ-দুঃখের রাস্তা দিয়ে প্রভুর রথের গতি, অভিমানকে দলে দলে। গতকাল রাতে কোথায় যেন বেধেছিল রথের চাকা। খুলে গেল আবার।
গোঁসাই ফিরছে। সঙ্গী বলল, যেতে যেতে রাত হবে, খাওনি কিছু। দাঁড়াবে কোথাও?
গোঁসাই বলল, চা খাব। দাঁড়াস একটু।
চায়ের দোকান ফাঁকা। বৃষ্টি হয়েছে খানিক আগে। চা হাতে দিয়ে দোকানি বলল, আরেকটু হলেই বন্ধ করে বাড়ি যাচ্ছিলাম। ভাবলাম এই দুর্যোগে কে আর আসবে? দেখো, ভাগ্যিস বন্ধ করিনি, তাই চা পেলে।
গোঁসাই বলল, আমিও দোকানের ঝাঁপ ফেলে বসেছিলাম। অভিমানে। ভেবেছিলাম যে আসবে সে দরজায় ধাক্কা দিয়ে আসবে। কিন্তু সে কি আসে ওইভাবে? খোলা দরজার সামনে আসে নানান বেশে। বন্ধ দরজার বাইরে ভিতরে শুধু আমিই। আর আমার অভিমানের দম বন্ধ বাতাস। যখন এলো না সে, এক সময় থাকতে পারলাম না, দিলাম দরজা খুলে। ভাবলাম এবার তার অভিমানের পালা…. হয় তো আসবে না….. মাহেশে গিয়ে দেখলাম সে এসে দাঁড়িয়েই ছিল….. দেখিনি….. অভিমান সব চাইতে বেশি ভয় পায় কাকে বলো তো…. অভিমানকে…. তাই সে জগতজুড়ে অভিমানেরই ছায়া দেখে….. মিথ্যা গো…. তার অভিমান নেই… এ কথাটা বুঝতে জীবন যায়... এ কথাটা বুঝলেই সব সোজা... কোথায় ভয়.... কোথায় বিষাদ...তার অভিমান নেই... নেই নেই নেই.... সে আবর্জনা শুধু আমার..... তোমার চা খুব ভালো হয়েছে….. যাই তবে…..
দোকানি বলল, আবার এসো। দরজা বন্ধ থাকলে ডেকো।
গোঁসাই বলল, ডাকব না। অপেক্ষা করব। এক সময় না এক সময় তো খুলবেই।
দোকানি বলল, দেরি হয়ে যায় যদি?
গোঁসাই বলল, দেরি হয় না। ফুল ফুটলেই ভ্রমর আসে। দেরি হয় না। তবে তো জগত কবে পরাগহীন হয়ে শুকিয়ে মরত। তোমার আমার বেঁচে থাকা মানেই পরাগযোগ ঘটানো গো… এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে….. প্রেমের মকরন্দে প্রভুর পরাগ…. মাখবে না গায়ে…. পথ পরিষ্কার রেখো….. তার রথের চাকা যেন না আটকায়…. খেয়াল রেখো….. বাকি সব হয়ে যাবে….. আসি…. ভালো থেকো…..
বৃষ্টি শুরু হল আবার। দোকানি বসে উদাস। চায়ের সরঞ্জাম সাজানো সামনে। সে রাস্তার দিকে চেয়ে। রথের চাকার শব্দ শুনছে কি?