Skip to main content

 

chobbishbar.jpg

 

পরেশ বাঁশগুলো কতবার গুনল মনে করতে পারছে না। আর চাইছেও না। রতন, সুভাষ, কনক একটা জায়গায় জড়ো হয়ে, উবু হয়ে বসে বিড়ি টানছে। পরেশের সঙ্গে নয় নয় করে এদেরও প্রায় বারো বছরের উপর হল কাজ করছে। পরেশের বয়েস ষাট ছুঁই ছুঁই। রোগাটে গড়ন। শরীরে রোগের বালাই কিছু নেই। পরেশ জড়ো করা বাঁশগুলোর উপর খাতা-পেন বার করে হিসাব মেলাবার চেষ্টা করছে। বেলা দশটা হবে। বাড়ির সামনে বড় উঠান। তার পাশে পুকুর। হাঁস চরছে ক'টা। রোদটা চড়া। পরেশ যেখানে বসে তার মাথার উপর বড় আমগাছ একটা। আর ওরা যেখানে বসে সেখানে দোতলা বাড়িটার ছাওয়া পড়েছে। এ গ্রামে এরা এককালে জমিদার ছিল। ভালো মানুষ। এখন দুই ভাই, একতলা, দোতলায় থাকে। এদের মা কাশীতে থাকেন। এখন এসেছেন। বড় ভাইয়ের একটাই ছেলে। সেই ছেলেটাই চারদিনের জ্বরে ভুগে মারা গেল। তারই কাজ আজকে।

বাড়ির এককালের কর্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন কাশীতে থাকেন। হাতে জপের মালা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। দুটো গাল সূর্যের আলোয় লাল হয়ে গেল দেখতে দেখতে। পরেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবু'র বাবার কাজে তুমিই এসেছিলে না?

পরেশ এতক্ষণ খেয়াল করেনি যে রমা বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ গলার আওয়াজে চমকে গিয়ে খাতাপেন প্রায় ফেলে দিয়েই দৌড়ে এল। বলল, কিছু বলছিলেন মাসিমা?

রমা বললেন, না…. তুমি তো এ বাড়ির পুরোনো লোক। এই বলছিলাম। তা কাজ শুরু করবে তো? আগে চা খেয়ে নাও… ঝুমা…. অ্যাই ঝুমা….. বাইরে চারটে চা আর বিস্কুট নিয়ে এসো তো।

পরেশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রমা বললেন, তোমার সঙ্গে যারা এসেছে ওরা হিন্দু তো….

পরেশ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ মাসিমা।।

রমা ভিতরে চলে যাচ্ছিলেন। পরেশ দাঁড়িয়ে। রমা যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, দুপুরেও এখানেই খেয়ে নিও…. তোমাদের আলাদা রান্না হবে, অশৌচ নিয়ে ভাবতে হবে না। জানো তো নাতিটা আমার কী লোকজন ভালোবাসত।।

পরেশের গলা ধরে এল। কথাটা তো সত্যিই। রাস্তায় যেখানেই দেখা হোক চীৎকার করে ডাকত…. প্যাণ্ডেল কাকু…. আমার জন্য আমবাগানে একটা ঘর বানিয়ে দিও না…. আমি আর এই সাইকেলটা থাকব….. হবে?

=========

পরেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ দেখে না। নিজেও কাজে লাগে। আজ হচ্ছে না। হাত শিথিল হয়ে যাচ্ছে। কাঁপছে। ত্রিদিবের মুখটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। ওর জন্যে প্যাণ্ডেল? হা ঈশ্বর!

অম্বিকেশ ব্রাহ্মণ এল। পরেশকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো….. বলল, পরেশ এ বাড়ি আমি আমার বাবা বংশপরম্পরায় পুজো করে আসছি। বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত রাধামাধবের আমরাই সেবা করি। এ বাড়ির কর্তার সঙ্গে আমি আর বাবা একসঙ্গে, আলাদা আলাদা, আর না হোক বার ছয় বৃন্দাবন ঘুরে এসেছি। আমার পুজোয় কী ত্রুটি ছিল বলো তো….

অম্বিকেশ রাধামাধব মন্দিরের দরজার বসে পড়ল। দুটো চোখ জলে টলমল করছে। বলছে, সেই আমাকে ওর কাজ করাতে হবে? আমি না বলেছিলাম। কিন্তু ওই যে, আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। তাই এরা বললেন, আমাকেই করতে হবে। করব, পরেশ, তাই যদি কপালে থাকে করব।

পরেশ উত্তর করল না। সবার চায়ের কাপ একটা থালায় রেখে পাতকুয়ো তলায় রেখে এল। পরে মাজবে। অম্বিকেশ ঘরে ঢুকে গেল।

পরেশ আকাশের দিকে তাকালো। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। বৃষ্টি হতে পারে। ভাদ্রের আকাশ তো। বড়দা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ত্রিদিবের বাবা। তার কাছে এসে বলল, একবার উপরে এসো তো।

পরেশ 'হ্যাঁ না' কিছু বলার আগেই বড়দা উপরে হাঁটতে শুরু করল। তার থেকে কত ছোটো, কিন্তু এটাই রীতি, বড়দা আর ছোড়দা বলে ডাকা। ছোড়দা অফিসের কাজে বিদেশে গেছে। আসতে পারেনি। পরেশ উপরের ঘর জানে। ঘরের দরজার কাছ অবধি বড়দা এসে বলল, ভিতরে যাও, আমি আসি, পরে কথা বলব।

ঘরে খাটের এক কোণায় বড়বৌদি বসে। জানলার দিকে তাকিয়ে। শূন্য দৃষ্টি। পরেশ ঢুকে দাঁড়াল। বৌদি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওর কাজের জায়গাটা একটা এরোপ্লেন বানিয়ে দেবেন। আসলে ওর ইচ্ছা ছিল খুব প্লেনে চড়ার। কিন্তু সুযোগ দিল কই? ওর ছবিটা আমি ওই প্লেনে রাখতাম। পারবেন?

পরেশ কিছু ভাবল না। বলল, পারব।

বৌদি বলল, আপনি আমার থেকে অনেক বড়, বাবার মত। আমাকে বলুন তো…. আত্মা বলে কিছু কি হয়? বাবু কী একেবারেই নেই, না আছে দাদা?

পরেশ জানে না আত্মা বলে কিছু আছে কিনা। সে বলল, দাদাভাই কোথায় যাবে আপনাকে ছেড়ে বৌদি…. সে নিশ্চয়ই আছে…..

বৌদি বলল, আচ্ছা, আপনি যান দাদা। ঝুমাকে একটু ডেকে দিয়ে যাবেন তো, মাথাটা ভীষণ ধরেছে। একটু চেপে দেবে।

=========

পরেশ বাইরে কুয়োতলায় এসে দেখল ঝুমা বসে বসে কাচছে। পরেশ বলল, তোকে ডাকছে রে উপরে….. বৌদি….

ঝুমা বসে বসেই বলল, যাব পরে। অমন সুন্দর ছেলেটাকে মারল। ক'দিন পরেই দেখবে পালাবে। রাতদিন ফোন করে যাচ্ছে। ওইতেই সব। আমি নিজে দেখেছি মেলায়, বৌদির সঙ্গে। আমাকে দেখেই বলেছে, কাউকে বলিস না ঝুমা বাড়িতে, তোর দাদাকে তো চিনিস। আসলে ওর বৌদির বাবা তো জোর করে বিয়ে দিয়েছে এখানে। অজাত কুজাতের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছিল। বৌদিদের বাপের বাড়ির ওখানে আমার ননদের জা থাকে। সব শুনেছি। ও মেয়েছেলের চরিত্র ভালো না। তুমি মিলিয়ে নিও। বড়দা ভালো বলে পুলিশ কেস করল না। আমি হলে নিশ্চিত বলতাম ওকে বিষ খাইয়ে মেরেছে।

পরেশের মাথাটা ঘুরছে। ঝুমা কী সব বলে যাচ্ছে? হঠাৎ দোতলায় চোখ পড়তে দেখে বড়বৌদি স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। চোখ দেখে পরেশের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা বাতাস খেলে গেল। তাড়াতাড়ি সরে এসে বাঁশে উঠতে শুরু করল, তিরপলে ঢেকে ফেলতে হবে সব বলে।

বড়দার আরেকটা পরিবার আছে দেওঘরে। পরেশ জানে। সবাই জানে। কেউ বলে না। দেওঘরে বড়দা'র মাসির বাড়ি। সেখানে যাতায়াত করতে করতেই সম্পর্ক। পরেশ দেওঘর সৎসঙ্গে বছরে দু'বার-চারবার যায়। মন চাইলেই ছোটে। সেখানেই স্টেশানে দু-একবার দেখেছে বড়দাকে। মাসি তো নেই। মারা গেছে। তবে? কিন্তু বড়দা তাকে দেখে এড়িয়ে গেছে, সে-ও আর জিজ্ঞাসা করেনি। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে। অনেকেই বলে, মাসিমা জানেন সব। সেখানে গিয়েও নাকি থেকেছেন। কিন্তু এই বৌদির বাপের বাড়ির অনেক উঁচু জায়গায় ধরা বলে একে তাড়াতে সাহস পায় না কেউ-ই। কিন্তু বড়বৌদিও?

পরেশ জানে সংসার বড় পিছল রাস্তা। তারও পা পিছলেছে। ওই সময় বোঝা যায় না। কোথা থেকে একটা ভ্রমের আত্মবিশ্বাস এসে জন্মায় বুকে। কিন্তু তাই বলে বাচ্চাটাকে?

=========

বড়দা বাইক নিয়ে ফিরল। পরেশ বসেছিল। বড়দাকে দেখেই সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, দাদাভাইয়ের কী হয়েছিল গো?

প্রশ্নটায় সুরটা বড় তীক্ষ্ম হয়েই গেল। বড়দা বাইক থেকে নেমে বলল, গাঁ-শুদ্ধ সবাই জানে আর তুমি জানো না….

পরেশ চমকে গেল। এভাবে কথা বলে না বড়দা। বড়দা উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছে। পরেশ বলল, লোকে তো অনেক কথাই বলছে বড়দা….. পুলিশে যাওনি কেন…. অমন রাজপুত্রের মত ছেলে…..

আসলে ঝুমার কথাটা শোনার পর থেকে অসহ্য লাগছিল পরেশের। তার যখন ভরা যৌবন বৌ তাকে একা ফেলে পালিয়েছিল। শীতকাল। সেদিন থেকে আজও ভোরের কুয়াশা দেখলে ভয় লাগে পরেশের। ভোরে উঠে দেখে বউ নেই। এত কুয়াশা আজীবন দেখেনি সে। তার উঠানে তুলসীবেদীটা অবধি দরজায় দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছিল না। বুকটা আজও খামচে ধরে থাকে ভোরের কুয়াশা। মানুষ মানেই তো কুয়াশা।

বড়দা ঘরে চলে গেল। সব কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যে হল। ঝুমা এসে বলল, ঠাকুমা ডাকছে তোমাকে।

পরেশের মনে হয়েছিল কিছু একটা হবে। মাসিমার ঘরে গিয়ে ঢুকতেই মাসিমা একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, ওখানে বসো।

মাসিমা বলল, আমি জানি গ্রামে অনেকেই অনেক কথা বলছে। তুমিও কিছু কিছু জানো। দেওঘরের ঘটনাটা বাবু আমাকে জানিয়েছে। দেখো, বয়েস তো তোমারও হয়েছে। সংসার বোঝো। ওই ছেলে যদি বেঁচে থাকত তবে ওর মা ওকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতত, এ জমির দখলদারিও নিত। আমি কেন সহ্য করব? বংশ বংশ ধরে অনেক পরিশ্রমে এ সম্পত্তি আমাদের। বাবুর স্বভাবচরিত্র আমি জানি। এক মেয়েমানুষে ওর মন ভরে না। ভরবেও না। ওর বাবাও এক জিনিস ছিল। কিন্তু বড়বৌ? ছি ছি! মেয়েমানুষ হয়ে…. ওর বাবার অনেক চেনাশোনা বলে আমি ভয়ে চুপ করে থাকি। নইলে আমার ছেলেটাকে হাজতবাস করিয়ে ছাড়ত।

পরেশের প্রচণ্ড গরম লাগছে। দরজাটা বন্ধ করে ঝুমা চলে গেছে। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।

ও যাবেই। আজ না হয় কাল যাবেই। আর ছেলেটাকে নিয়ে যাবে। সে আমি হতে দেব না। তখন আমার ছোটোছেলে, ও একটা জিনিস নিয়ে এল। ওতেই যা হওয়ার হল। দেখো, তোমার ছোটোছেলের বউ কীভাবে মারা গেল আমরা জানি…. কিন্তু পাঁচকান করিনি। তোমার ছেলে জেলে না গিয়ে যে এখন তোমার সঙ্গেই কাজ করে খায়…. তুমি চেয়েছ বলেই না তোমাদের কর্তাবাবু সেইমত পুলিশকে জানিয়েছে।

পরেশ বলল, আমাকে এসব বলছেন কেন?

রমা বলল, ঝুমাকে সরাতে হবে। বড়বৌকে বারমুখো হওয়ার রাস্তা ওই দেখিয়েছে। ওর মারফৎ সব যোগাযোগ। ওর ঠাটবাট কী বেড়ে গেছে বোঝো না? এসব জোগাচ্ছে কে? কিন্তু বাচ্চাটাকে ভালোবাসত বলে এখন বেঁকে বসেছে। কিন্তু ও কিছু একটা আন্দাজ করেছে। তুমি ওকে সরিয়ে দাও। বাকিটা আমি দেখছি।

পরেশ শান্ত হয়ে বসে। অস্বস্তিটা হচ্ছে না। একটা আরাম লাগছে। এ কাজ আগে কত করেছে। আজকাল কেউ ডাকে না। ভিতরে কোথাও একটা নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতা তৈরি হত। সংসারে পিঁপড়ের বিষ আর গোখরোর বিষ সমান না। তা জাতসাপ। যেদিন তার বাড়ির ভিত খোঁড়া হবে, সেদিন জানবে পরেশকে ঠকাতে এলে কী পরিণাম হয়। কংকাল পেলে বুঝবে ওটা কার! কুয়াশা ভেদ করতে জানে পরেশ। কিন্তু তাই বলে ছোটোবাবু? ওটা তো হিজড়া একটা! ছি! ছি! শালা গা ঢাকা দিয়েছে তবে?

ছোটোবাবু কোথায়?

বেশি জানতে চেয়ো না। যতটা বললাম করো। কাজ হলে জানিও কর্তাবাবু যা দিত তার দ্বিগুণ দেব।

এ ঘটনার মাস তিন পরে, কুয়াশার মধ্যে একদিন বাড়ুজ্জে বাড়ির ছোটোছেলের গলার নলিকাটা দেহ পাওয়া গেল। কেউ ধরা পড়ল না। ও বাড়ির বড়বৌ পাগল হয়ে গেল।

পরেশ কুয়াশা ভেদ করতে জানে। হিজড়ের এতবড় স্পর্ধা সহ্য করেনি পরেশ। বাড়ুজ্জে বাড়ির এসব কাজের দায়িত্ব তার। সে যাকেই সরানো হোক। ও হাত দেওয়ার কে?