তোমারও যা, আমারও তাই। যন্ত্রণা। দুর্ভোগ। অশান্তি। মরবে?
হ্যাঁ। আপনি? এত বয়েস হল, আর ক'টা দিন অপেক্ষা করে গেলে হত না? এত ঝক্কি। আজ নাকি একটু পর বান আসবে। দেখে বাড়ি চলে যান। আমি ডুবি। নইলে আমার তো উপায় নেই। দেখছেন তো দাড়িগোঁফ কিচ্ছু পাকেনি। আপনার তো ও পালা শেষ হয়ে গিয়ে টাকও পড়ে গেছে। যান যান, বাড়ি যান।
কেন ভাই, এসো না, এই তো ঘাট, দু'জনে হাতটা ধরে টুক্ করে নেমে পড়ি। বান আসুক। ভাসিয়ে নিয়ে যাক। এসো না।
দাঁড়ান, কেউ আসছে। পুলিশ মনে হচ্ছে। হ্যাঁ পুলিশই তো! চুপ করে বসুন। যা উত্তর দেওয়ার আমি দিচ্ছি।
(পুলিশ রাস্তা থেকে এদিকে একবার ঝুঁকল। টানা সিঁড়ি নেমে গেছে ঘাটে যাওয়ার, রাস্তা থেকে। একে অন্ধকার, তায় মেঘলা। স্ট্রিটলাইটের আলোয় হালকা দেখা যাচ্ছে। দুটো মানুষের মত শরীর নিয়ে দুটো জীব কুঁকড়ে সিঁড়ির নীচের দিকের ধাপে বসে আছে।)
অ্যাই…. কে তোরা? কী করছিস?
স্যার বাবাকে গঙ্গার হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে এসছি…. ঘরে খুব গরম…. বস্তিতে বাড়ি স্যার…. হাওয়া বাতাস ঢোকে না…. অ্যাই দেখুন… বাবা….
(বলতে বলতে অল্পবয়স্ক মানুষটা বৃদ্ধের মাথাটা ঘাড়সমেত ঘাটের টিমটিমে আলোর দিকে তুলে ধরল। আলোর পোকা ঘুরছিল ক'টা। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করল। সারা মুখ পাকা দাড়ি, না কাটা, গালে লেগে থাকা দাড়ি। চোয়াল ভাঙা। তুবড়ে ভেতরের দিকে চলে গেছে মুখের।)
পুলিশ ঝুঁকে দেখল রাস্তা থেকে। চলে গেল। বৃদ্ধ ঘাড়টা সোজা করে বলল, আরেকটু হলেই মটকে যাচ্ছিল তো…..
যেত যেত…. মরতেই তো এসেছেন…..
(দু'জনে চুপচাপ বসে। হাওয়া দিচ্ছে। গরম। বৈশাখ ছাড়িয়ে কালই জ্যৈষ্ঠ পড়েছে। বৃদ্ধ অল্প অল্প তাল দিয়ে, হাঁটুর উপর কী একটা গান গাইছে।)
বাবা…! মরতে এসে গান গাইতে এই প্রথম দেখলাম….
ক'বার মরতে এসেছ হে….. আমি অনেকবার…. তুমি?
আমিও। আপনি? মানে কী কারণ জানতে পারি কি…. বান আসতে দেরি আছে। সেই সময়টা একটু নিজেদের দুঃখের কথাই না হোক শোনা যাক।
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ধুস্। ওসব বলে শুনে কী লাভ। মোটকথা জীবন আমাদের এমন এক জায়গায় এনে ফেলেছে, বা নিজের দোষে এসে পড়েছি যে জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেছে। আমাদের দু'জনেরই আর জীবনের কাছে নতুন করে কিছু চাওয়ার নেই। এই তো?
তা খুব ভুল বলেননি।…. এই… এত রাতে মহিলা আসছে কেন?
(একজন মাঝবয়েসী মহিলা। খুব সাধারণ একটা শাড়ি গায়ে, আসছে ধীর পায়ে। এসে এই দু'জনের থেকে কয়েকটা সিঁড়ি উপরে বসল। ফোনটা বার করল সঙ্গে আনা ব্যাগ থেকে। একটা নাম্বার ডায়াল করে বলল, বলো)
দু'জন চুপ। ওদিকে কথা হচ্ছে….
তুমি জানোই তো ওকে… ইতিমধ্যে সন্দেহ শুরু করেছে…. ছেলেটা না থাকলে…. হ্যাঁ হ্যাঁ….. কবে?.... মানে তো সোমবার….. (কড় গুনে) আর তো চারদিন…. না না….. অ্যাই…. ওই সময়ে আমার ডেট…. হবে না…. না, ওসব ওষুধ আমি খাই না… খুব শরীর খারাপ লাগে… টুকাইয়ের বাবা হানিমুনে যাওয়ার আগে খাইয়েছিল….. না হলে ওর গোটা ট্যুরের টাকাই বেকার হয়ে যাচ্ছিল….. অ্যাই চুপ অসভ্য…. না এখানে ছবি ভালো আসবে না….. আরে আলো নেই….তাছাড়া লোক আছে….. আচ্ছা দেখছি…..
বৃদ্ধ, ক্ষীণ শব্দে…. কী বুঝছ…. এ তো মরেই আছে গো…. তুমি এমন রস চুকচুকে প্রেম করেছ?
না…. আমি চিরকাল আদর্শবাদী…. মানুষের জীবনের একটা নীতি তো আছে…. নইলে পশুর সঙ্গে কী ফারাক তার? আজ মানুষের মধ্যে যদি সততা বলে কিছু থাকত, হয়তো আমাকে আপনাকে এইভাবে বসে থাকতে হত না এখানে…. আমরা তো আসলে মৃত… এখন শুধু শরীরটাকে মারতে এসেছি।
(শেষের কথাগুলো বেশি জোরে হয়ে গেল। মহিলা ফোনটা কান থেকে সরিয়ে তাদের দিকে তাকাল। তারপর ফোনটা কানে দিয়ে বলল, পরে করছি। ব্যাগটা নিয়ে উঠে চলে গেল।)
বৃদ্ধ বলল, মরেচে… তা আত্মহত্যা মহাপাপ… সে নীতির কী করলে?
গলা টিপে মেরে দিয়েছি। সব নীতির গলা টিপে মেরে এখানে এসে বসেছি।
ভালো করেছ। মানুষের নীতি পোষায় না হে। ওটা দেওয়ালের রঙ। আসল গাঁথনি ওতে না।
মরতে এসেছি বলেই যে বলব গোটা সংসারটা পচে গেছে…. তা না। অনেক ভালো মানুষ আছে। কিন্তু আমার আর পোষাচ্ছে না। আমার কলিজার জোর নেই। দুর্বল আমি। তাই সরে যাচ্ছি। যারা পারছে, আছে।
আমার কিন্তু অন্য কথা। আমার জীবন। নিজের মত কাটিয়েছি। চাকরি-বাকরি, সংসার ইত্যাদি সব করেছি। এখন ধরেছে মারণরোগে। প্রস্টেটে। কেন হাসপাতাল আর ডাক্তারের চক্কর কেটে টাকা আর শ্রমের বৃথা ব্যয় করব? তাই…..
ডাক্তার কী বলছে, আর আশা নেই?
খানিক সেরকমই…..
হুম...।
(আবার সব শান্ত। হঠাৎ পিছন থেকে কয়েকজনের আওয়াজ শোনা গেল। ওই মহিলা আরো কয়েকজন সঙ্গে, আবার পুলিশও। তারা হুড়মুড় করে নামল। পুলিশ দু'জনকেই ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, সুইসাইড? কেন? চলো থানায়।
দু'জনেই ভালো করে দেখল, এ পুলিশ আগের পুলিশ কিনা। বুঝল না।)
অল্পবয়স্ক বলল, কিছুটা ইতস্তত করেই বলল, কিছুক্ষণ আগেই যে আপনাকে বললাম….
আমাকে? নেশা করেছ নাকি? আমি তো এই এলাম…. এসেই শুনি ইনি বলছেন তোমরা নাকি সুইসাইড করতে বসে আছ…... চলো থানায়….
বৃদ্ধ বললেন, স্যার… কিছু ভুল হচ্ছে….
অমনি মহিলা খেঁকিয়ে উঠে বলল, আমি মিছা বলছি? শালা বুড়োভাম…. তোরা একটু আগে ওইসব কথা বলছিলি না?.....
বৃদ্ধ বলল, কিছু ভুল হচ্ছে মা…. তুমি তো ফোনে কথা বলছিলে না? এই কম আলোয় কী করে ফটো পাঠাবে…. তোমার বর সন্দেহ করছে…. এইসব….
(মহিলার মুখটা পাংশু হয়ে গেল। একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, কী সব বলছেন…. ভীমরতি হল নাকি?.... আপনি দেখুন স্যার… আমি দেখি ছেলেটা ঘুমালো কিনা….)
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে বলল, কী বলছিল ওই মেয়েছেলেটা? ফটো পাঠাবে? আর কী বলছিল?
(বৃদ্ধ একবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে, আড়ালে অল্পবয়স্ককে চোখের ইশারা করল।)
অল্পবয়স্ক ইশারাটা বুঝে, তৎক্ষণাৎ গলার স্বর পাল্টে বলতে শুরু করল, আরে সে অনেক কথা…. হানিমুনের কথা…. পিরিয়ড, মানে মাসিকের কথা…..
পুলিশ দু'একবার কিছু জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করল। কিন্তু জনতা ঘিরে বসে পড়েছে দু'জনকে। তারাও বাস্তবের সঙ্গে অভিজ্ঞতা, কল্পনা, দমিত কামের জ্বালা উজাড় করে বলে যেতে লাগল। শ্রোতারাও সত্য-মিথ্যা বিচার ভাসিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। এমন টাটকা রস…
শ্রোতারা ঘুমিয়ে পড়েছে। বান এসে চলে গেছে। সবার কাপড়জামা ভিজে। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালো। ভোর হচ্ছে। অল্পবয়স্ক উদাস চোখে ভোরের আলোর থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে। বৃদ্ধ বলল, চলো, চা খাই।
টাকা নেই।
আমার আছে। চলো।
চায়ের দোকান খুঁজতে খুঁজতে পেলো। সেই মহিলা। দোকান খুলেছে সদ্য। তাদের দেখে বলল, বসুন। জল চাপাচ্ছি।
দু'জনে বসল। পাশাপাশি। মাইকে চণ্ডীপাঠ চালিয়েছে কেউ। এখন বড্ড বেমানান। কোথাও হনুমান চালিশা চলছে। খানিকবাদে দুই ভাঁড় চা মহিলা এগিয়ে দিল। নিজেও একটা কাঁচের কাপে চা নিয়ে বসল। বলল, এদিকে বাড়ি তো না।
দু'জনেই মাথা নাড়ল।
মহিলা বলল, আমি ভালো স্পট জানি। যেদিন আবার আসবেন আমাকে একটা ফোন করে দেবেন, নিয়ে যাব।…. যা শুনেছেন, সব নিশ্চয়ই বলে সেরেছেন… আর না বললে ওরাই বা ছাড়বে কেন?
বৃদ্ধ চায়ের টাকা দিতে গেল।
থাক। শুধু মুখটা বন্ধ রাখবেন। আর না মরতে চাইলে এদিকে আসবেন না…. মরতে চাইলে এই আমার নাম্বার… কল করবেন। আমার শ্বশুরকে নিজের হাতে বিষ দিয়ে মেরেছি। সবাই জানে। প্রমাণ নেই, তাই ক'দিন আটকে ছেড়ে দিয়েছে। চাইলে অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু মড়া মেরে কী করব? আপনারা হলেন আটকে যাওয়া পাঁক…. যত দূরে যান তত মঙ্গল…..
অল্পবয়সী বলল, তা তুমি যেটা করছ..
অ্যাই হারামজাদা, ঢ্যামনা শালা…. যা করছি আমার মর্জিতে, আমার গতরে করছি….. মা কালী সাক্ষী, আমার বিবেকে কোনো খোঁট নেই। তোদের মত না…. যা হবে দেখে নেব…. যা ফোট্ এখান থেকে….
দু'জনে ধীর পায়ে রাস্তার গলিতে মিলিয়ে গেল। একটা মোড়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। বৃদ্ধ বলল, আসি, যার জীবনের যেমন ছন্দ, যেমন বিশ্বাস। ওই একদিন বানের অপেক্ষা করবে না কে বলতে পারে? অল্পবয়স্ক বলল, নাও হতে পারে। হয় তো ওর বেঁচে থাকার সাধ হেরে যাওয়ার তাপ থেকে বড়… অনেক বড়…..। বৃদ্ধ বলল, আমাকে দেখ…. আমার কি সাধ নেই? কিন্তু শরীর? অল্পবয়স্ক বলল, আজই তো মরছেন না…. যে ক'টা দিন আছে…. বাঁচুন…। বৃদ্ধ বলল, হুম্। তুমিও দেখো, সব হারিয়েও কিছু নিশ্চই বেঁচে আছে। কুড়িয়ে বাড়িয়ে কিছু করা যায় কিনা।
দু'জনেই আলাদা হাঁটতে শুরু করল। দু'জনেই কয়েক পা গিয়ে পকেটে মহিলার ফোন নাম্বার লেখা কাগজটাকে নাড়িয়ে দেখে নিল। আছে।
গঙ্গার সেই ঘাটে এখন প্রচণ্ড ভিড়। কাজে যাওয়ার তাড়া। স্নানের তাড়া। কাচাকাচির তাড়া। জীবনের তাড়া।