বাবা আর ছেলে বিষণ্ণ সন্ধ্যায় পাশাপাশি বসে। বাবার বয়েস আশি পেরিয়েছে। ছেলের পঞ্চান্ন পেরিয়ে এল সদ্য। দুজনে রাস্তার ধারে চিরপরিচিত কোণা ভাঙা পুরোনো বেঞ্চটায় বসে। দুজনেরই স্ত্রী গত। বাবা মিস্তিরি ছিল। ছেলের আর চারটে সাইকেল সারানোর দোকানের মত অতিসামান্য পাড়ার একটা দোকান। দুজনেরই বলার কিছু নেই। দেখার কিছু নেই। আরেকটু রাত বাড়লে শুতে যাওয়া যায়। ততটা রাত হতে এখনও বাকি।
আষাঢ়ের আকাশে মেঘ নেই, শুধু অবিন্যস্ত তারা। গুমোট গরম। দুজোড়া শূন্য দৃষ্টি মাটি আর আকাশের মধ্যে কোথাও আটকে আছে। জল হয়ে নামে না। বাষ্প হয়ে ওড়ে না। ছেলে বলল, শীত আসলে এবারে দুটো কম্বল কিনতে হবে। বাবা বলল, আমার এ বছর চলে যাবে। সামনের বছর…. কেন জমানো….। ছেলে বলল, তোমার কাশিটা বেড়েছিল গেলবার শীতে। বাবা বলল, এখনও বুকে চাপ, সেই থেকে। ছেলে বলল, কাল হাসপাতালে যাবে? বাবা চুপ করে অন্যদিকে তাকালো। মানে, না, যাব না।
ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে দুজনেই কথা বলে না। ডুবে থাকে সে সব দিনে। দুজনে আলাদা আলাদা চোখের জল ফেলে। দুজনের দীর্ঘশ্বাসেদেরও দেখা হয় না। তবু মৃত্যু আসবে। একজন চলে যাবে। ছেলে ভাবে, বাবা। বাবা ভাবে ছেলে। দুজনেই ভয় পায়। পাশাপাশি বসে। কথা কিছু নেই। দুজনেই খোঁজে, কী কী ভুল হয়েছিল। সুখ হাতড়ায়। এখন যা স্মৃতির চালুনিতে আটকে থাকা কয়েকটা মাত্র কণা।
বৃষ্টি নামল অনেক রাতে। দুজনেই জেগে। বৃষ্টির আওয়াজ তো অন্তর্যামী। বাবা বলল, জানলা লাগিয়েছিস? ছেলে তখন বাবার ঘরে জানলা লাগাচ্ছিল। ছেলে বলল, ঘুমাওনি? বাবা বলল, হঠাৎ হাত থেকে পড়া বাসনের আওয়াজের মত বলল, আমায় ছেড়ে যাস না…..আমি….
ছেলে মেঝেতে বসল। খাটের পাশে। বলল, তুমিই যেও….গিয়ে বোলো সে খুব কষ্টে আছে। খুব কষ্টে।
দমকা হাওয়ায় জানলাটা গেল খুলে। ছিটকিনি দুর্বল। সজল হাওয়া এসে লাগল বাবা ছেলের সজল মুখে। শীতল। আশ্বাসের মত। কেউ যেন কোথাও আছে। অপেক্ষায়।