বহু বহু যুগ আগের কথা। গভীর জঙ্গল। দুদিন ধরে প্রবল ঝড়বৃষ্টির পর আজ এই সন্ধ্যেবেলা চারদিক সুস্থির হয়েছে। একজন নগ্ন পুরুষ গুহা থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে এসেছে পানীয় জল সংগ্রহের জন্য। এসে দেখে নদীর ধারে আরেক নগ্ন পুরুষ দাঁড়িয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। আকাশে তখন একে একে তারা উঠেছে। চাঁদ ওঠেনি তখনও।
গুহাবাসী বলল, ওহে অপরিচিত, অজ্ঞাত মানুষ, তুমি কি এই জঙ্গলেই বেঁধেছ ঘর? আগে তো দেখিনি কোনোদিন?
অজ্ঞাত বলল, আমি পথিক। দুদিন প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগে আটকে গিয়েছিলাম। ছিলাম ওই বটবৃক্ষের তলায়।
গুহাবাসী বলল, কিসের খোঁজ তোমার? যাও কোন দেশে?
অজ্ঞাত বলল, দুঃখের অবসান কিসে? এত দুঃখ মানুষের…কেন? তার উত্তরের খোঁজে চলেছি আমি।
গুহাবাসী বলল, সে একই খোঁজ আমারও। তাই আমিও ছেড়েছি সংসার। তুমি হলে পথিক, আমি হলাম গুহাবাসী। এসো না, আজ রাতে হও আমার অতিথি। দুজনে কথা বলি। জানি কে কী কী জেনেছি দুঃখের থেকে ত্রাণের উপায় খোঁজে?
=======
দুজনে বসে গুহার সামনে। গোটা জঙ্গল সদ্য প্রবল বর্ষণে স্নাত। তারার আলোয় স্নিগ্ধ চিত্রপটের মত চারিধার। বর্ষাজলপুষ্ট ঝরণার ভারী জলপ্রপাতের শব্দ, পাখির শব্দ, জঙ্গলের নানা প্রাণীর শব্দে মুখরিত হচ্ছে জঙ্গলের দশদিক। এর মধ্যে গুহাবাসী বললেন, কী মত তোমার পথিক? সংসারে দুঃখের কারণ কী?
পথিক বলল, সুখের অভাব। ক্ষুধার তাড়না যায় সুস্বাদু খাদ্যে। তৃষ্ণার তাড়না যায় শীতল স্বচ্ছ জলে। তেমনই সুখের উন্মেষেই দুঃখের অবসান।
গুহাবাসী বলল, অত সুখ আছে এ ধরায়? যা জীবনের সব দুঃখকে শোষণ করে দেয় অনন্ত সুখ?
পথিক বলল, জানি না নিঃসংশয়ে। তবে এ জগতের স্রষ্টা যিনি, শাসক যিনি, তিনি নিশ্চয়ই রেখেছেন অসীম সুখের ভাণ্ড তার প্রিয় সন্তানের জন্য, তার আলয়ে। সেই করুণাময় পিতার আলয়ে পাওয়া যাবে সর্বসুখের অমৃত প্রস্রবণ।
দেখতে দেখতে চাঁদ উঠল। পথিক সেদিকে তাকিয়ে বলল, সহস্র নক্ষত্রখচিত, সূর্যচন্দ্র দিয়ে গড়া কী অদ্ভুত পিতার আলয়।
গুহাবাসী বলল, তবে সে সুখ আসবে মৃত্যুর পর…পিতার আলয়ে উপস্থিত হলে।
পথিক বলল, তাই কি নয়? পিতার ইচ্ছানুযায়ী চলো যদি, পিতা হবেন প্রসন্ন, দেবেন তোমায় তার আলয়ে প্রবেশের অনুমতি মৃত্যুর পর। চাও না কি তুমি?
গুহাবাসী বলল, না বন্ধু। আমার মনে হয় দুঃখের কারণ সুখের অভাব নয়। দুঃখের কারণ বাসনা। যদি বাসনাশূন্য হও, তবে আসবে শান্তি। শান্তিতেই সব সুখের আগার।
পথিক বলল, বাসনাশূন্য! সেও কি সম্ভব? তাও এই রক্তমাংসের শরীরে? কী দুরূহ কল্পনা তোমার বন্ধু! পিতার অনুগামী হও। সেই সর্বোৎকৃষ্ট সহজতম পথ। পিতার করূণা বয়ে আনবে স্বর্গের সুখময় রাজ্যের আমন্ত্রণলিপি। কিন্তু বাসনা ত্যাগ? বাঁচার প্রেরণা কী হবে তবে?
গুহাবাসী বলল, প্রেম।
পথিক বলল, প্রেম কি বাসনা নয়?
গুহাবাসী বলল, প্রেম যদি ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্দেশ্য চরিতার্থতার জন্য হয়, তবে সে বাসনা। কিন্তু যদি হয় উজ্জ্বল স্ফটিকের মত প্রেম, যে প্রেমে অন্যের মুখের নিজের ছায়া পড়ে! সে তো চিত্তের সর্বোৎকৃষ্ট ধন।
পথিক বলল, নিজেকে অবলুপ্ত করা সে প্রেমে আমি কই? আমিই যদি না থাকব, তবে কে ভোগ করবে অনন্ত সুখ পিতার আলয়ে!
গুহাবাসী বলল, প্রেমের জ্যোতিতে যে আত্মজ্যোতি জ্বলে ওঠে চিত্তে, সে জ্যোতিতে আমি আর আমার পিতা এক! করুণার শিশির বিন্দুতে টলমল পিতার অসীম প্রজ্ঞার সসীম প্রতিফলন।
পথিক বলল, এ গুহায় একা থেকে থেকে তোমার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে! পিতাকে নিজের চিত্তে বসাতে চাও? ছি ছি ছি! কী অহঙ্কারী তুমি! কী উদ্ধত!
গুহাবাসী বলল, না না বন্ধু, ভুল বুঝছ আমায়। আমার চোখে নক্ষত্রলোকের প্রতিফলন সে আমার ঔদ্ধত্য নয়, সে আমার মধ্যে অসীমের আত্মপ্রকাশের আকুতি।
পথিক বলল, তুমি ভ্রান্ত! তুমি উন্মাদ!
গুহাবাসী বলল, আমি কী আমি জানি না বন্ধু। শুধু জানি সব দুঃখের অবসান এই বাসনাময় ক্ষুদ্র আমি-র ভিক্ষাপাত্র ত্যাগে। তুমি যাও, বাধা দেবার আমি কেউ নই। তবে সুখের তৃপ্তিতে শান্তির বীজ নেই জেনো। আছে লোভের বীজাণু। আরো অশান্ত করবে তোমায়!
পথিক বলল, আমি যাই। তুমি লুপ্ত হবে কদিনের মধ্যে এ সৃষ্টি থেকে। এই আমাদের শেষ বিদায়। পিতার আমন্ত্রণপত্র নিয়ে যাব যেদিন এ পথ দিয়ে, সেদিন দুর্ভাগ্য তোমার, পাবে না দেখতে পিতার স্বর্ণাজ্বল সাক্ষর!
পথিক চলে গেল। গুহাবাসী বলল আত্মগত হয়ে, পিতার সাক্ষর আমার সর্বাঙ্গে বন্ধু, কণায় কণায়। লুপ্ত হব না আমি। আমি অমৃতের সন্তান। অবিনশ্বর। পরিপূর্ণ আমি প্রেমে, আনন্দে। আমি তোমাতেও, চিনলে না আমায়।