Skip to main content

 

সাধন সামন্ত কচুয়া গ্রামে থানায় বড়বাবু হয়ে এলেন। প্রথম দিন থানায় গিয়েই দেখেন থানায় বাচ্চাবুড়ো মহিলা সব লাইন দিয়ে বসে। সব নাকি ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কেন? সেটাই কথা। কেন?

সাধনবাবুর কিঞ্চিৎ গর্ব হল না যে তা নয়। তবে খানিক ঘাবড়েও গেলেন। গ্রামেগঞ্জে ভেবেছিলেন চাকরির শেষ ক'টা দিন একটু হেসেখেলে বেড়াবেন। তাই সপরিবার এসেছেন। ওঁর স্ত্রী আর মেয়ে, কুকুন। সে ক্যারাটে শেখায়। বিয়ে করবে না। ইচ্ছা এই গ্রামে একটা ক্যারাটে স্কুল খোলে। মেয়েদের শেখাবে বিশেষ করে। সেও এসেছে বাবার সঙ্গে থানায়। সেও বেশ উৎসুক চোখে তাকিয়ে, এত লোক?

থানার হাবিলদার, জয়ন্ত প্রামাণিক এগিয়ে এসে বলল, একজনকে ডাকি স্যার, সেই সবটা বুঝিয়ে বলবে।

সাধনবাবু ঘাড় নাড়লেন। মেয়ে পাশে বসে, সেও বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল। জয়ন্তবাবু একজন সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়সী মানুষকে নিয়ে ঢুকল। সে এসে হাতজোড় করে বলল, নমস্কার স্যার। নমস্কার ম্যাডাম। বসি?

সাধনবাবু আগত মানুষটার গলার আওয়াজ শুনে মুগ্ধ। কী রোগা চেহারা। কিন্তু কী মিষ্টি গলার আওয়াজ! আহা!

সে বসার অনুমতি পেয়ে বলল, আমি এই কচুয়া গ্রামপঞ্চায়েতে সামান্য কাজ করি। আমার নাম প্রকাশনা বাড়ুই। আমিই ব্যাপারটা গুছিয়ে বলছি। আসলে সমস্যাটা শুরু হল স্মার্টফোন আসার থেকে।

সাধনবাবু তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আহা! কী কথাই বললেন….কী যেন…আকাসোনা….খোকাসোনা…..

পাশ থেকে মেয়ে বলল, বাবা প্রকাশনা…..

হ্যাঁ হ্যাঁ প্রকাশনাবাবু, গোটা বিশ্ব এই বিষাক্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে যন্ত্রায়িত।

শেষ শব্দে হোঁচট খেলেন নিজেই। এমন কোনো বাংলা শব্দ হয়? কে জানে। যাক গে। বলতে লাগলেন, আমার মেয়ে, তার মা, তার স্বামী, তার স্বামীর অফিসের সবাই, তার সমাজের সবাই। কে না? আমার ইচ্ছা এই নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখি নিউ ইয়র্ক টাইমসে। কিন্তু ওদের সম্পাদকীয় বিভাগে পাঠকের চিঠি বলে কিছু পাচ্ছি না। মানে ঠিকানাটা। আপনি জানেন?

প্রকাশনাবাবু দুই হাত কচলে বলল, আমাদের অফিসে ওর ঠিকানা আছে কিনা দেখব। কিন্তু স্যার সমস্যাটা ঠিক ফোন নিয়ে না। আরো গভীরে।

সামন্তবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

প্রকাশনাবাবু বলতে লাগল, আসলে এই স্মার্টফোন আসা ইস্তক সব সেলফি তোলা শুরু করেছে।

প্রকাশনাবাবুকে থামিয়ে বড়বাবু বললেন, আহা, সে আমি তুলি, আমার মেয়ে তোলে, ওর মা তোলে, আমার শালী তোলে, তার বর তোলে…..

প্রকশনাবাবু ধৈর্য রাখতে না পেরে বলল, আজ্ঞে সে সবাই তোলে…সমস্যাটা তো তাও নয়।

সামন্তবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, তবে?

প্রকাশনাবাবু কাঁধে ঝোলানো একটা বড় ঝোলা ব্যাগ থেকে গোটা কুড়ি ফোন বার করে টেবিলে সাজাতে সাজাতে বললেন, দেখাচ্ছি…..

একটা একটা স্ক্রিণে একটা একটা ছবি ভেসে উঠল। সব সেল্ফি। তবে সব সেল্ফির সঙ্গেই একজন বুড়ো মানুষের মুখ।

সামন্তবাবু বললেন, হে হে, এই বৃদ্ধ কে হে? এই গ্রামের প্রধান বুঝি?

অমনি বাইরে থেকে একজন মহিলার গলা খাঁকারি ভেসে এলো। সঙ্গে অনুনাসিক প্রতিবাদ…..কিঁ কঁতা বঁলেন…আঁমি এঁই গেঁরামের কুঁড়ি বঁছরের পোঁদান…আঁমি কেঁন…..

প্রকাশনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আহা, তুমি চুপ করো না মাসি….উনি কী করে জানবেন…এ গ্রামে কালই তো এসেছেন….ওঁকে ব্যাপারটা বুঝতে দাও।

সামন্তবাবু একটু অপ্রস্তুত। এমন কথা বলাটা উচিৎ হয়নি। যা হোক, সামনের ছবিগুলো দেখতে দেখতে বললেন, তা ইনি কিনি?

প্রকাশনা বলল, আজ্ঞে এঁর বিরাট খাটাল ছিল। নিজের খাটালে, নিজের গরুর গোবরে পা পিছলে পড়ে যান, ও মারা যান…..

সামন্তবাবু বললেন, চ্চু চ্চু! আহা! তা মারা যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে ছবি তুলতেন…এমন মিশুকে গোয়ালা আমি কোনোদিন দেখিনি….আহারে! এমন ভালো মানুষটা….বুঝেছি, এই ভালো মানুষটার খাটাল, সে মারা যাওয়ার পর কেউ হড়প করে নিচ্ছে নিশ্চয়ই…. আমি এসেছি যখন হতে দেব না…..চল তো মা…..

এই বলে সামন্তবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। বাইরে থেকে আবার এক কণ্ঠ ভেসে এলো….আঁ মোঁলো….এঁ মিঁনসের যেঁ গোঁটা কঁতা শোঁনার তঁর সঁয় নাঁ……

প্রকাশনাবাবু বলল, আজ্ঞে এই ছবি ওঁর মারা যাওয়ার পর থেকে। উনি কেউ সেল্ফি তুললেই মাথা গলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। এমনকি একসঙ্গে এক সময়ে যদি চারজন সেল্ফি তোলে চারজনের ছবিতেই উনি। সবাই বিরক্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে স্যার। সেল্ফি তোলা ছাড়া আজকের জীবনে কী স্বাধীনতা আছে মানুষের বলুন? সেটুকুও আমার গ্রামের লোক পাবে না?

বাইরে থেকে অনেকেরই নাক টানার আওয়াজ এলো। সবাই কী কাঁদছে? সামন্তবাবুর ছবিগুলোর দিকে তাকাতে আর সাহস হচ্ছে না। কিন্তু সত্যিই কী?

ওদিকে এ সব আলোচনা হতে হতে সামন্তবাবুর মেয়ে মোবাইল বার করে খচাৎ করে একটা সেল্ফি তুলেছে। ব্যস, অমনি অম্বরীশবাবুর মুখ। অম্বরীশ ঘোষ। জিভ বার করে ভেংচি কাটছে।

সামন্তবাবু বললেন, তা ইনি দিনেদুপুরেও….মানে রাতেটাতে তেনারা বেরোন শুনেছি….কিন্তু আমি এর কী করতে পারি বলুন তো……

সামন্তবাবু কপালের ঘাম মুছে মেয়েকে বললেন, কী করি মা?

মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে বলল, তুমি দাঁড়াও। আমি আসছি। বলেই প্রকাশনাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, অম্বরীশবাবুর খাটালটা একবার দেখব, চলুন তো।

=========

খাটালটা বন্ধ। সামন্তবাবু থানায় থেকে গেলেন কাগজটাগজের কাজের জন্য। প্রকাশনাকে নিয়ে কুকুন এসে ঢুকল খাটালে। চারদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল।

কুকুন বলল, উনি কোথায় পড়েছিলেন?

প্রকশনা একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, এই যে….এইখানে।

জায়গাটা চওড়া। এককালে বাঁধানো ছিল বোঝা যাচ্ছে। পাশেই একটা কুয়ো। নষ্ট হয়ে গেছে অব্যবহারে।

কুকুন বলল, উনি কি একাই থাকতেন?

প্রকাশনা বলল, হ্যাঁ। ভাই ছিল, সন্ন্যাসী হয়ে গেছে।

কুকুন বলল, সব একা সামলাতেন?

প্রকাশনা বলল, আজ্ঞে। আসলে বোবা ছিলেন। তাই…..

কুকুন ফিরে তাকালো প্রকাশনার দিকে। তাই গ্রামে কারোর সঙ্গেই কথাবার্তা হত না তেমন….তাই তো?

হ্যাঁ, ওই আরকি।

কুকুন চারদিক ঘুরে দেখতে দেখতে একটা পোড়ো বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। এই বাড়ি?

প্রকাশনা বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। দুটো ঘর। যাবেন? সাপখোপ…..

চলুন চলুন….একজন মানুষকে বুঝতে গেলে তার বাড়ি, ঘর দেখতে হয়। ভয় লাগলে আপনি বাইরে দাঁড়ান।

প্রকাশনা বাইরে দাঁড়ালো। বলল, আসলে আমার মেশো গতমাসেই চন্দ্রবোড়ার ছোবলে ছবি হয়ে গেছেন….তাই…..

কুকুন বলল, বেশ বেশ। আমি যাচ্ছি।

দরজাটায় আলতো ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। আশ্চর্য কোনো শব্দ হল না। ঘরের মেঝেতে ঘাস। হাঁটু অবধি। দেওয়ালে ছোটো ছোটো গাছ। ছাদের কড়িবরগাতেও গাছ। পাশাপাশি দুটো ঘর, মাঝে যাওয়ার দরজা। পাল্লা নেই। পিছনে বারান্দা। সেখানে ঘাস কম। কুকুন পাশের ঘরে গেল। দেওয়ালে একটা ফটো ফ্রেম। ছবি নেই। কাঁচ নেই। কুকুন ওই ঘরের দরজা দিয়ে পিছনের বারান্দায় এলো। কী শান্ত বাড়িটা। এই বাড়িতে একজন বোবা মানুষ কয়েকটা গোরুমোষ নিয়ে একা কাটিয়ে দিল? কুকুন চীৎকার করে বলল, প্রকাশনাবাবু ওঁর ভাই চলে যাওয়ার পর উনি কদ্দিন একা ছিলেন?

বাইরে থেকে গলা ভেসে এলো। আজ্ঞে বাইশ তেইশ তো হবেই।

কুকুনের চোখে জল এল। কী আশ্চর্য, একজন বোবা মানুষ! বাইশ বছর একা?

মোবাইলে খচ করে একটা আওয়াজ হল। কুকুন প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখে ছবি তোলা। সেল্ফি। অম্বরীশবাবুর। চোখে জল।

কুকুন ময়লা সরিয়ে বারান্দায় বসল। মোবাইলটা অন করে বলল, কিছু লিখবেন?

অপেক্ষা করল। কেউ কিছু লিখল না। কুকুন মোবাইলটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিল। কী করে কাটিয়েছিল মানুষটা জীবন?

মোবাইলটা বারান্দায় রেখে কুকুন পিছনের উঠানে এসে দাঁড়ালো। ডানদিকে একটা সিঁড়ি। ছাদে ওঠার। কুকুন ছাদে উঠতে উঠতে বলল, কিছু লেখার থাকলে লিখবেন। পাসওয়ার্ড হল, এক চার ছয় তিন।

ছাদে উঠে গ্রামটা বেশ সুন্দর লাগছে আরো। দূরে একটা খাল। আরো দূরে রেললাইন। লোকাল ট্রেন যাচ্ছে। প্রকাশনা দূরে একটা মাঠে বসে মোবাইল ঘাঁটছে। তাকে দেখে হাত নাড়ল। বলল, সাবধানে!

ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুন বলল, অম্বরীশ জেঠু, আপনি গ্রামের লোকেদের ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে কথা বলুন খালি। আমার সঙ্গে সেল্ফি তুলুন। হবে? আমি আপনাকে চিনি না। কিন্তু আমার ভীষণ ইচ্ছা এই বাড়ির সামনে আমি আমার ক্যারাটে স্কুল খুলি। আপনি চাইলে ওদের সঙ্গে সেল্ফি তুলতে পারেন। আমি দেখছিলাম আপনি বড়দের ছবিতে ভ্যাংচান, কিন্তু ছোটোদের ছবিতে হাসেন। হবে? আমি ওদের বোঝাব।

কেউ কোনো উত্তর দিল না। কুকুন নেমে এলো। এসে বারান্দা থেকে মোবাইলটা নিয়ে অন করল। দেখল লেখা আছে, রাজি, বড্ড একা লাগে তাই। আর একটা হাসিমুখের সেলফি।

এরপরের গল্পটা তেমন কিছু না। এখানে অম্বরীশ ক্যারাটে স্কুল হয়। সামন্তবাবু চাকরির অবসরে শহরে ফিরে গেলেও কুকুন থেকে গেল। বাড়িটা নতুন করে বানালো। গ্রামে অম্বরীশবাবুর সঙ্গে আর কারোর সেল্ফি ওঠে না। অনেকেই অভিমান করা শুরু করল। মানুষের মন! তখন কুকুন অম্বরীশবাবুকে অনেক বলে কয়ে রাজি করালো যে ওই কুয়ো পাড়ে যদি বড় কেউ সেল্ফি তোলে তবেই উনি মুখ দেখাবেন, নইলে না। আর একটা কথা, উনি কাউকে আর ভ্যাংচান না। বরং হাসি মুখেই তোলেন।