ছবি দু'দিন ধরে কিছু জিভে কাটেনি। দু'দিন পর জল আর মুড়ি নিয়ে বসেছে এমন সময় ফোনটা এলো।
ছবি ফোনটা খাটে ছুঁড়েই আলনা থেকে হলুদ সালোয়ার-কামিজটা নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, বাবু এক্ষুণি রেডি হ, দিদুনকে পাওয়া গেছে…. বেরোবো….
======
ছবির বাপের বাড়ি বৈঁচিতে। ছবি'র বিয়ে হয়েছে চাকদায়। ছবি দু'দিন আগে ফোন পায় তার মা মালতীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এরও আগের একটা গল্প আছে।
মালতী সদাশিবকে বিয়ে করে পালিয়ে গিয়ে। বাড়িতে মেনে নিচ্ছিল না সম্পর্ক। কারণ দুটো ছিল, এক সদাশিবেরা ছিল নীচু জাত; আর দুই, তাদের আর্থিক অবস্থা মালতীদের থেকেও খারাপ ছিল। তাই বাড়ির লোক রাজী হয়নি, শুধু তাই নয়, অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে একরকম জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। মালতী যখন সদাশিবের সঙ্গে পালায় তখন মালতীর বয়েস পনেরো।
বাড়ির লোক মালতীর অল্পবয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা নিয়ে যেমন পুলিশে নালিশ করেনি, তেমনই সম্পর্কও রাখেনি। ধীরে ধীরে তাদের সংসার সচ্ছল হয়। বৈঁচিতে জমি কিনে বাড়ি করে। ছবি হয়। তারপর সমীর হয়। সমীরের বিয়ে হয়নি এখনও, কথা চলছে।
মালতী'র মাথাটা ঠিক কাজ করছে না এই চার-পাঁচ বছর হল। সমীর আর ছবি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে ভাইবোনে মিলে। কিন্তু সবাই বলছে এটা চিকিৎসা হলেও সারে না। মা সব ভুলে যায়। রাস্তা চিনতে পারে না। মালতী থেকে থেকেই পুরোনো দিনের কথা বলে। এমনভাবে বলে যেন গতকালের ঘটনা। মালতী যখন তার মায়ের মারা যাওয়ার কথা শোনে পাগলের মত দৌড়েছিল বাপের বাড়ি। গিয়ে শোনে ওরা ত্রিবেণী শ্মশানে নিয়ে গেছে। মালতী দৌড়ায়। তখন ছবি আর সমীর দু'জনেই ছোটো। সদাশিব অসুস্থ, তাই বাড়িতেই ছিল। ত্রিবেণীতে এসে শোনে মা-কে চুল্লীতে ঢোকানো হয়ে গেছে। মালতীর সঙ্গে তার দাদারা যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করে, আর একপ্রকার তাড়িয়েই দেয়। বলে মায়ের অস্থি দেখার অধিকারও তার নেই।
বলাবাহুল্য, মালতী ছেলেমেয়ে নিয়ে ফিরে আসে। ছেলেমেয়ের সামনে শ্মশানে ওই শোকের মুহূর্তে অমন অপমান মালতী কোনোদিন ভুলতে পারেনি। সেই থেকেই তার মাথায় যেন কী একটা চলত। ভাষা, সময়, চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে যেত। যেন মাথার মধ্যে রাতদিন কে খোদাই করে চলেছে।
======
ছবি ফোনটা পায় ত্রিবেণী শ্মশানঘাট থেকে। তার মা-কে সেখানে পাওয়া গেছে।
রাস্তায় ছবি সমীরকে, তার স্বামী অসীমকে ফোন করে জানায়। তারাও ইতিমধ্যে যে যার কাজের জায়গা থেকে রওনা দিয়েছে। ছবি যখন তার এগারো বছরের ছেলেকে নিয়ে শ্মশানে পৌঁছায় তখন মালতী চাতালে শুয়ে। সারাটা গা ভিজে।
ছবি মায়ের বুকের উপর হামলে পড়ে। উপুড় হয়ে মায়ের মুখের কাছে মুখ এনে বলে, কেন এমন করলে মা? কেন?
পাশে কয়েকজন ভিখারি বসেছিল। প্রায় সবাই মহিলা। একজন বলল, আরে উনি কিছুই তো বলছেন না….. দু'দিন ধরে কতবার যে গঙ্গাস্নান করলেন তার ঠিক নেই। স্নান করে, ভিজে কাপড়ে শ্মশানের দিকে যায়, 'মা মা' করে ডাকে, আবার এসে বসে। প্রথম দিন তো কিছুই খায়নি। তারপরের দিন ওই জবা একটু ভাত আর আলুসেদ্ধ একটা থালায় দিল তো দু-গাল খেল।
ছবি জবা নামে মহিলার দিকে তাকালো। একটা লাল সবুজ ছাপা শাড়ি পরে স্থূলকায়া একজন মহিলা। তার দিকে তাকিয়ে দেখছে।
ছবি মালতীর ঘাড়ের নীচে হাত রেখে বলল, ওঠো মা… বোসো……
মালতী উঠল। কিন্তু কাউকে চিনতে পারছে বলে বোধ হচ্ছে না। বলল, চা।
ছবি দুশো টাকার একটা নোট ছেলের হাতে দিয়ে বলল, ওই চায়ের দোকানে যা। আর এখানে যারা বসে আছে সবার জন্য চা আর বিস্কুট দিয়ে যেতে বল। যা……
======
অপূর্ব দৌড়ালো। দিদাকে কেমন লাগছে। কান্না পাচ্ছে দেখে। চায়ের দোকানে যায়নি একা কোনোদিন। হঠাৎ নিজেকে বড় লাগছে কেমন। সবটা বলল। চাওয়ালা বলল, তুমি যাও, আমি পাঠাচ্ছি।
অপূর্ব-র ভালো লাগল না। কেন তাকে ছোটো ভাববে? তবু আবার এসে মায়ের পাশে দাঁড়ালো। মা দিদার ভেজা পিঠটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছে, কষ্ট হচ্ছে মা? কষ্ট হচ্ছে?
মালতী একবার ক্ষীণস্বরে বলল, মা-কে দেখতে দেয় কিনা দেখুন না একবার….. যাবেন?
একজন ভিখারি বলল, আহা রে!
ছবির গলার কাছে পাকিয়ে এলো কান্না। হয় তো গিলেই ফেলত। কিন্তু চোখ পড়ল রাস্তার দিকে। তার স্বামী আর ভাই নামছে টোটো থেকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ছবি।
সমীর এসেই জিজ্ঞাসা করল, তোকে ফোন কে করেছিল?
ছবি'র এতক্ষণ কথাটা মাথায় আসেনি। সে চমকে উঠে বলল, কী একজন মামা বলল…. আমি আর শুনিনি রে…..
একজন ভিখারি মহিলা বলল, একজন বয়স্ক মানুষ এসেছিলেন। উনিই ওঁকে চিনতে পারেন। বারবার বললেন, দিদি…. কী রে দিদি….. তো উনি তো সাড়াই দিলেন না….. তখন উনি একে তাকে বেশ কয়েকটা ফোন করলেন….
সমীর বলল, মামারা কেউ হবে হয় তো। এদিক ওদিক ফোন করে তোর নাম্বারটা জোগাড় করেছে নিশ্চয়ই।
ছবি বলল, বাবা?
কিছু বলছেন না। শুয়ে আছেন, আয়াদিদি বলল। সব শুনে শুধু বলেছেন, হা ভগবান! ব্যস অতটাই!
ইতিমধ্যে চা এসেছে। কার্তিক মাসের বিকেল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে এলো। সমীর, অসীম দু'জনেই টোটো ডাকতে গেছে। অপূর্ব মায়ের গা ঘেঁষে বসে। ছবি মায়ের কাঁধে মাথা রেখে।
টোটো এলো। সমীর আর অসীম মালতীকে ধরে দাঁড় করালো। রাস্তা অবধি হেঁটে তো যেতে হবে। ছবি বলল, কিছু টাকা দাও না গো।
ছবি টাকাটা মুঠো করে একজন ভিখারিকে দিতে দিতে বলল, তোমরাই মা-কে বাঁচিয়ে রেখেছিলে গো…. তাই মা-কে আবার ফিরে পেলাম….. এটা রাখো….. ভাগ করে নিয়ে নিও…..
সে টাকাটা ছবি'র হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এটা নেওয়া যায় না…. ভিক্ষা করে খাই ঠিক…. কিন্তু এটা অমানবিক… শ্মশানে সবাই হারায়… তুমি পেলে…. এ টাকাটা তুমি রাখো…..
তারপর সে ভিখারি মহিলা অপূর্বকে ডাকল, দাদুভাই…. শোনো…. এটা নাও…..
একটা পার্লেজি বিস্কুটের প্যাকেট।
ছবি মাথা নাড়ল। অপূর্ব নিল। সে মহিলা অপূর্ব'র দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলল, আমার নাতিটার মত চেহারা……