Skip to main content

 

chobbishbar.jpg

 

ধর্মের বিদ্বেষ? নাকি বিদ্বেষের ধর্ম? কে তলিয়ে ভাববে? তলিয়ে ভাবে কে? তলাতে গেলে অনেক পাঁক ঠেলতে হয়। সেই ঠেলতে ঠেলতে তল। এত খাটনি পোষায়?

মা তারা এক্সপ্রেস যখন তারাপীঠ রোডে এসে দাঁড়াল তখন বৈশাখের খাঁ খাঁ রোদ। ধূ ধূ মাঠের মধ্যে একটা স্টেশান। ওভারব্রীজ দিয়ে উঠতে গিয়ে সবুজ আর নীলের দিগন্তরেখায় চোখ আটকাল। দাঁড়ালাম। মানুষের ধর্ম কী দিগন্ত? বিদ্বেষ, না ভালোবাসা?

টোটোর লাইন পড়েছে। মানুষ আর মানুষ। ভালোবাসা কি ভোরের ক্ষণিক শিশির? উবে গেলেই রুক্ষ, অসহনশীল মানুষ? টোটো চলছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। দুপাশে মাঠ। মাটির বাড়ি। চামড়া পোড়ানো রোদ। গাছের ছায়া। ছায়ার নীচে মানুষ। ছাগল। ভেড়া। গরু। প্রাণ ছাওয়া চায়। প্রাণ বিদ্বেষ চায়। প্রাণ আনন্দ চায়। প্রাণ বিষাদ চায়। প্রাণ বলবান। প্রাণ দুর্বল।

দুপুর। মন্দির খুলেছে সদ্য। “ভিড় নেই, যান যান, এখানে জুতো রাখুন। আমার কাছ থেকে নিন পুজোর ডালা। যান যান। মা ফাঁকা এখন।”

যাই তবে। মা মানে বিশ্বাসের প্রথম বীজ। তার থেকে বাকি সব। সত্যিই ভিড় নেই। বিশ্বাস আছে। প্রথা আছে। রীতি আছে। কারোর কাছে শুধুই অন্ধবিশ্বাস। কারোর কাছে শুধুই ব্যবসা। কেউ আসে। কেউ আসে না। কেউ চোখের জলে দাঁড়িয়ে। কেউ তোয়াক্কা করে না। কারোর কাছে শুধুই মাতালের আড্ডা। কারোর কাছে শ্মশানের রহস্য।

আমি দেখি মানুষ। মানুষকে তার ভালোবাসায় দেখি। তার আশা আকাঙ্খায় দেখি। তার শূন্য প্রাণের ঝুরে ঝুরে ভেঙে পড়া দেখি। ভাঙা টুকরোগুলো নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে সে বলে, কেউ জুড়ে দেবে না? কেউ নেই জুড়ে দেওয়ার? দরকারি মানুষ। বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া মানুষ। ধনী। দরিদ্র। জিতে যাওয়া। হেরে যাওয়া। সব মানুষ ভিড় করেছে। ভিক্ষা-প্রার্থনা মন্দিরে। রাস্তায়। আট বছরের মেয়েটা তার তিন বছরের বোনকে কোলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। ভিক্ষা করতে করতে খেলছে তার “ভিখারি” বন্ধুদের সঙ্গে। বলা ভালো বয়স্যদের সঙ্গে। সুখী মানুষ আত্মমগ্ন। দুঃখী মানুষ উদাস।

এদিকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কড়া নেড়ে চলেছে মানুষের বুকের মধ্যে আরেক মানুষ। মনের মানুষ। কেউ আজীবন শুনতে পায় না। কেউ শুনেও ভয়ে সাড়া দেয় না। কেউ সাড়া দিয়েও লুকিয়ে পড়ে।

“মাকে স্পর্শ করবেন না?”

কী বলো গো? মায়ের স্পর্শেই মাকে চিনেছি। সেই স্পর্শ ললিতে বাজা ভোরের সানাইয়ের মত। সে আমাকে স্পর্শ করেছে। তাকে স্পর্শ করার অধিকার দিয়েছে। মাকে দু’হাত জড়ো করে বলছি, মা, সবার ভালো হোক। সবার ঘরে উনুন জ্বলুক। সকালবেলা ঝাঁটা পড়ুক বাসি ঘরে। দিনে রাতে আসা-যাওয়া থাকুক মানুষের, পাখির, পশুর। ঝড় উঠলে সামাল দেওয়ার দেওয়াল থাকুক। বৃষ্টি রোদে সামাল দেওয়ার ছাদ থাকুক। খুব গরমে মেঝেতে শোয়ার আঁশটে গন্ধহীন মাদুর থাকুক।

হালকা মন। কানাইদাস বাউল নেই। গান গাইতে গেছেন দূরে কোথাও। প্রণাম জানিয়ে এলাম কানাইদাস বাউলকে মনে মনে। বাউল তুমি বলো তো, ধর্মের বিদ্বেষ? নাকি বিদ্বেষের ধর্ম? বিদ্বেষ কি ভাতের হাঁড়িতে দু মুঠো চাল অতিরিক্ত নেয়? বিদ্বেষ কি স্নানের পর ভেজা গামছা রোদে মেলে আসে? বিদ্বেষ কি শুতে গিয়ে মশারির মধ্যে মহাকাশ খোঁজে? বিদ্বেষ কি শিশুর সঙ্গে খেলতে খেলতে হেরে গিয়ে জিতে যায়? বিদ্বেষ কি তোমার পাড়ায় ফুলের গন্ধ হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়?

হঠাৎ করে বৃষ্টি হল কয়েক পশলা। মুহূর্তেই সব তাপ হারিয়ে গেল কোথায়। জোলো হাওয়ায় শীতল হল চারদিক। সন্ধ্যে হয়েছে। আরতি শুরু হল। ঢাক বেজে উঠল। পঞ্চপ্রদীপের আলো চক্রাকারে ঘুরছে। বাইরে স্ক্রিনে সে ছবি। সামনে সেই ছবি। যারা দূরে, তারা তাদের আত্নীয়ের মোবাইলে দেখছে। লাইভ। বৃদ্ধা ডান হাতটা শক্ত করে ধরে বাঁ হাত দিয়ে। মোবাইলটা নড়ে না যায়। মোবাইলের ওপাশে মেয়ের মুখ। অসুস্থ কি? পঞ্চপ্রদীপের আলোয় কার মুখের আদল ভাসে মা? বিদ্বেষ, না ভালোবাসার? বিদ্বেষের কি আলো হয় মা?

পাণ্ডা মন্ত্র পড়ছে। সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গোটা পরিবার। হাত জোড় করে। মা আর মায়ের সন্তানের সামনে পাণ্ডা কেন? টাকা লাগবে আরো পঞ্চাশ। পাণ্ডার চোখে রাগ। পাণ্ডার চোখে ভৎর্সনা। হাতজোড় করা ভক্তদের চোখে বিহ্বলতা। পুণ্যের দর কষাকষি। কে জিতবে? চাতুরী?

মা হাসেন। সন্তানের চাতুরীতে হাসেন। সবাই ভাবে সে জিতে গেছে। মা হাসেন। দিগন্ত ছড়িয়ে হাসেন। সবাই জেগে। জেগে থাকার ফারাক আছে। কেউ ভোরের আলোয় জেগে। কেউ বেলার আলোয়। কেউ দুপুরে। কেউ বিকেলে। কেউ গোধূলির আলোয়। কেউ সন্ধ্যেতে। কেউ রাতে। সবাই সবার মত জেগে। তোমার কথা সবাই বুঝবে কেন? সবার কথা তুমিই বা বুঝবে কেন? চলো। তুমি শুধু চলো। এ জীবন তো তীর্থ মন। চলো। চলো। বিদ্বেষ তো পাথেয় নয় মন। পাথেয় শুধু দুটো চোখ আর একফালি হৃদয়।

 

(ছবি - Joydeep Ghosh)

Category