Skip to main content

 

003.jpg

১৮৯৮ সাল। কে এস ঘোষ। তিনি তখন দেওঘর হাইস্কুলের ছাত্র। হেডমাস্টার একদিন বললেন, বিশ্ববিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ দেওঘরে এসেছেন, যদি তোমরা কেউ চাও গিয়ে দেখা করে প্রণাম করে আসতে পারো।

স্বামীজি সত্যিই তখন দেওঘরে। শরীর ভালো নেই। মূলত স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যেই আসা। কে এস ঘোষ তার স্মৃতিকথায় লিখছেন, আমি আর এক বন্ধু মিলে গেলাম স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে। মনে মনে ভাবছি দুজন স্কুলের ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে কি স্বামীজির মত মানুষ সময়ের অপচয় করবেন? মনে হয় না। যা হোক সে বাড়ির বাগানে ঢুকতেই বুক ধড়ফড় করতে লাগল।

স্বামীজি উষ্ণ অভ্যর্থনায় ওদের গ্রহণ করলেন। গল্প শুরু হল। কে এস ঘোষ লিখছেন আমি জানি উনি অদ্বৈত বেদান্ত নিয়ে মূলত লেকচার দিয়েছেন। আমি যত কথা সেদিকে ঘোরাতে যাই উনি সেদিকে না গিয়ে স্বাস্থ্য, শুচিতা এইসব নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। খানিকবাদে আমরা হাঁটতে বেরোলাম। উনি কিছু দূরের একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, গেছো তোমরা ওখানে? আমরা যাইনি শুনে বললেন, যাবে, অবশ্যই যাবে। রবিবার তো ছুটি থাকে। বিকেলে বেড়াবে। ওতে শরীর স্বাস্থ্য, মন সব ভালো থাকে।

আমরা ওঁর সঙ্গে হাঁটছি আর বিস্মিত হচ্ছি আমাদের মত ছাত্রদের সঙ্গে কী সহজে মিশে যাচ্ছেন দেখে। হঠাৎ রাস্তার মধ্যে দাঁড়ালেন। আমরাও দাঁড়ালাম। তারপর আমার পা দুটো নিরীক্ষণ করছেন দেখি। আমি ইতস্তত করতে শুরু করলাম। জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না, কী দেখছেন?

উনি বললেন, তোমার জুতোর ফিতে বাঁধাটা তো ঠিক মত হয়নি হে!

অ্যাঁ! মানে কী? বলে আমি নতুন জুতো পরে এলাম আজ ওঁর দেখা করার এমন পবিত্র একটা দিন, এই ভেবে। আমি তাকালাম নিজের জুতোর দিকে। বুঝলাম না। তাছাড়া জামাপ্যান্ট এইসব ব্যাপারে আমি বেশ পরিপাটি। কেউ সে নিয়ে কোনো কথা বলে না, তবে?

এমনিতে তো শাস্ত্র, ঈশ্বর কিছু নিয়েই আলোচনা করেননি সারাটা রাস্তা। তায় আমি ওপার বাংলার মানুষ শুনে বললেন, তোমরা যে মাছ খাও বেশি সেটা খুব ভালো। এইসব কথাই হচ্ছে। আমি অবাক হচ্ছি সন্ন্যাসী বলতে আমি যা বুঝি এ তো তা নয়, সব দিকে এত খুঁটিনাটি নজর!

যা হোক। কিন্তু সে জুতোপর্ব তো এখনও সমাধা হল না। স্বামীজি হাতের ইশারা করে দেখালেন ফিতে দুটোতে গোলমাল কোথায়। কিন্তু নার্ভাসনেসে হোক, কী আর কোনো কারণে আমি বুঝতেই পারছি না। উনি এগিয়ে এসে বললেন, দাও আমি ঠিক করে দিই। আমি এতটাই নির্বোধ আমার পা বাড়িয়ে দিলাম। স্বামীজি রাস্তায় নীচু হয়ে বসলেন। আমার জুতোর ফিতেটা ঠিক করে বাঁধলেন।

হ্যাঁ সেই স্বামীজি, যিনি শিকাগো থেকে গোটা বিশ্বকে নিজের বাগ্মিতায়, পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ করে এসেছেন। তিনিই এই দেওঘরের নির্জন রাস্তায়, একজন অতি অতি সাধারণ ছাত্রের জুতো নীচু হয়ে বসে বেঁধে দিচ্ছেন।

স্বামীজি নিজেই শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছেন, ঠাকুর নিজের মাথার চুল দিয়ে মেথরের বাড়ির পায়খানা পরিষ্কার করেছিলেন। যদি এমন মানুষকে দেখার জন্য মাইলের পর মাইলও হেঁটে যেতে হয় তবে রাজী, অনেক অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ শূন্যগর্ভ ভাষণ শোনার চেয়ে।

কে এস ঘোষ পরবর্তী জীবনে হাজারিবাগ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক হন। স্বামীজি রচনাবলীর দশখণ্ড ওঁর পড়া হোক বা না হোক স্বামীজির যে পরিচয় উনি সেদিন পেয়েছিলেন, আর বাকি কী জানার থাকে তারপর?