যত অপরাধ, সে তো আইন আছে বলেই। যদি আইনটাকে দুর্বল করে দেওয়া যায়, তখন অপরাধকে আর কতটা কঠোর লাগে? লাগে না। তাই যে সমাজে অপরাধ অহরহ নানা বেশে ঘটেই চলেছে, সেখানে মানুষ সেটাকেই “নিউ নরমাল” ভেবে নেয়। মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্তও হয়—আমি কি বেশি ভাবছি? বেশি প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি? ঘটনাটা কি এতটাই ভাবার মতো? নিজের মধ্যে নিজের বোধ-বুদ্ধি, মূল্যবোধ—সব কিছু নিয়ে সংশয় তৈরি হতে শুরু করে।
আবারও শুরুর কথাটা বলি, সমাজে অপরাধ তাকেই বলে, যা আইনের বিরুদ্ধে যায়। তবে আইন কী? এই নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। সে দিকে না গিয়ে বলি—এককালে আইন বলতে বোঝাত দিব্যবিধান। মোটামুটি সব সমাজেই আদিকালে একজন দিব্য বিধানকর্তার ব্যবস্থা থাকত। তাঁর কিছু রক্ষক থাকত, যারা ক্রমে ভক্ষকে পরিণত হতে শুরু করল। পাশ্চাত্যে চার্চ আর রাজার সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের বিচার—সর্বত্রই নানা কুলীন আইনি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। যেমন মনুসংহিতা—কত নানাবিধ স্মৃতি!
ক্রমে দিন বদলাল। ঈশ্বরীয় আইন, রাজার আইন বদলে বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্রের আইন প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু সেই আইনও ত্রুটিহীন হল না, অপব্যবহারের সম্ভাবনামুক্তও হল না। কারণ? কারণ ঈশ্বর বিদায় নিলেন, কিন্তু লোভ তো থেকেই গেল। লোভের বিকার, প্রতিহিংসার বিকার, লালসার বিকার যাবে কোথায়? তাকে আইন-আদালত থামাতে পারে না। তবে আইন-আদালত কী পারে? সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে পারে না, কিন্তু অপরাধীমুক্ত করতে পারে—যতটা দূর সম্ভব।
অপরাধ আর অপরাধী—দুয়েরই অস্তিত্ব আইনের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। একসময় আমাদের সমাজে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি সামাজিক বিধি ছিল। সেগুলো অপরাধ ছিল না, কারণ সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো আইন ছিল না। দেশের কয়েকজন মহানুভবের বিবেকে কথাটা বেজেছিল বলেই তাঁরা সরাসরি আইন আনার ব্যবস্থা করেন, এবং সমাজে তার প্রতিফলনও দেখা যায়।
কিন্তু যেগুলো সামাজিক অমানবিক প্রথা, সেগুলোকে না হয় সেইভাবে আটকানো গেল। যেগুলো মানুষের বিকারের ফল? ক্রিমিনাল প্রোফাইলিং ইত্যাদি অত্যাধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির কতটুকু বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে আমাদের দেশে? হয়, হচ্ছে; না হয়, হচ্ছে না।
কিন্তু আইন? আইনের কাজ কি শুধু শাস্তি দেওয়া? অনেক বড় বড় কঠোর সাজা হয়েছে। কিন্তু যে অপরাধ করে, সে কি শাস্তির ভয় পায়? নাকি তৎপর আইনব্যবস্থার ভয় পায়?
আমার মনে হয়, এখানেই একটা সূক্ষ্ম ফারাক আছে। দু-একটা ফাঁসি বা যাবজ্জীবনের ভয় যতটা না ভয় জাগায়, তার চেয়েও বড় ভয় হচ্ছে এক সতর্ক, সতেজ প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপস্থিতি। যে মানুষ প্রতিদিন দেখে সমাজে অপরাধ ঘটছে, এবং আধা-ঘুমন্ত, আধা-জাগ্রত আইনব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার ক্রমে দুঃসাহস বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে সে আরও বড় অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কারণ, অপরাধ করার মধ্যে একটা স্বেচ্ছাচারিতার আনন্দ তো আছেই। সমাজ স্বেচ্ছাচারিতায় বাধা দেয়, আইন বাধা দেয়—অপরাধ বাধা দেয় না। সে কাউকে ভয় পায় না, ভয় পায় কেবল সততার তৎপরতাকে। সেই সততাকে সে দ্বিচারিতা আর ভণ্ডামির ব্যাখ্যায় দেখে বলেই, খাঁটি সত্যকে নিয়েও তার একসময় সংশয় জন্মে যায়। আর সামাজিক নানা ঘটনায় তার উদাহরণের অভাব নেই। তাই আজও আমাদের দেশে সৎ, তৎপর, আইননিষ্ঠ মানুষকে হিরো বলে মনে করা হয়। তাদের নিয়ে সিনেমা হয়। মানুষ বিস্মিত হয়। দেখে ভাবে—সত্যিই যদি এমন হত!
কিন্তু তৎপরতা মানে কী? কোনো একটা অপরাধ ঘটল, আর তড়িঘড়ি কাউকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হল—এই কি তৎপরতা? একজন অসুস্থ হলে, তৎপর চিকিৎসক কি হাতের কাছে যেটা পান সেটাই ব্যবহার করে চিকিৎসা শুরু করেন? না কি সংগত ওষুধ ব্যবহার করেন? একজন মাথা ফাটিয়ে এলে, চিকিৎসকের কাছে যদি শুধু হাত ভাঙার সরঞ্জাম থাকে, তবে তিনি নিশ্চয়ই রোগীর হাত ভেঙে চিকিৎসা দেখাবেন না! তেমনই, আইনের রক্ষকের কাছেও সংগত তৎপরতাই আশা করা যায়।
সব শেষে বলি, আইনের দুর্বলতায় অপরাধের গুরুত্বও দুর্বল হয়ে যায়। মানুষ সেই অবস্থাকেই ধীরে ধীরে “নিউ নরমাল” ভাবতে শুরু করে। এখানেই একটি মানুষের, একটি সমাজের নষ্ট হয়ে যাওয়ার বীজ লুকিয়ে থাকে। একজন মানুষ যখন বোঝে—যা ন্যায্য, তার আর কোনো আশাই নেই, তখন অন্যায্যকেই বাস্তব ধরে নেয়। একজন ডায়াবেটিক রোগী যখন নিজের কিংবা আশপাশের কারও পক্ষ থেকে মিষ্টি খাওয়ার কোনো বাধা পান না, এবং শরীরেও কোনো তৎক্ষণাৎ দুর্লক্ষণ দেখা যায় না, তখন তাকেই তিনি স্বাভাবিক অবস্থা বলে ধরে নেন—যতক্ষণ না মৃত্যু শিয়রে এসে উপস্থিত হয়।
আমাদেরও কি গতিপথ সেই দিকেই?