পিপুল ভুইয়া রবিবার করে পাসওয়ান মাষ্টারের বাড়ি যায়। আরো অনেকে আসে। সবাই তাদের মত। মানে যাদের বাড়ি বিহার, উত্তরপ্রদেশ এইসব জায়গায়, কিন্তু অনেকদিন ধরে এই বাংলায় আছে।
পিপুল ক্লাস ফোরে পড়ে। আজ যে জামাটা পরে এসেছে সেটা মামা দিয়েছে। মামা রায়পুরে হোটেলে কাজ করে। গত মাসে তার জন্মদিনে এসেছিল। জামা-প্যান্ট, ভিডিওগেম, জুতো কত কী দিয়েছে।
পিপুলের ক্লাস ছুটি হল একটায়। কাল আম্বেদকর স্যারের জন্মদিন, পাসওয়ান মাষ্টার তাই সবাইকে দুটো লাড্ডু, একটা কেক খাইয়েছে। বেরোনোর সময় সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছে - জয় ভীম!
পিপুল স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখল রোদটা কম। মেঘ করে আছে। একটু চিন্তা হল, যদি বৃষ্টি হয়, জামাটা ভিজে যায়। এই জামাটা পরেই আজ বিকেলে মায়ের সঙ্গে কাঁচরাপাড়ায় সেলের মার্কেটে যাওয়ার কথা। কী হবে?
ফরজনা বলল, পিপুল বাড়ি যাবি? আজ আমি তোদের পাড়ার দিকে যাব। আমার মা ওখানে যে বাড়িতে কাজ করে দুপুরে ওখানে খাওয়া আছে।
ফরজানার মা যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়িটা বাঙ্গালির। কলেজের মাষ্টার - বাবা বলে। বাবা ওদের বাড়ি দুধ দিতে যায়।
পিপুল বলল, তোর সঙ্গে ছাতা আছে?
ফরজনা বলল, আছে? কেন রোদ নেই তো।
পিপুল বলল, নাহ, এমনি। চল।
=======
পিপুল আর ফরজানা বড় দীঘির পাশ দিয়ে আসছে। সরু রাস্তা। চারদিকে ঝোপঝাড়। পোকা ডাকছে। দীঘির জলে মেঘের ছায়া পড়েছে। পিপুলের দেখে ভয় লাগছে। জামাটা এখনও ভালো করে শুঁকলে সে নতুন জামার গন্ধ পায়। ফরজানা কী সব বলে যাচ্ছে। কানে আসছে না পিপুলের।
বেশ কিছুটা এগিয়ে, পিপুল দেখল তার বাবা বড় অশ্বত্থগাছটার নীচে বসে আছে। বাবাকে হঠাৎ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কোভিডের পর থেকে শরীরটা কী রোগা হয়ে গেছে। একটু বেশি চলাফেরা করলেই শ্বাসকষ্ট হয়। পিপুল ফরজনাকে বলল, তুই এগো, আমি বাবার কাছে যাই।
ফরজনা পিপুলের দিকে তাকালো। বলল, আমিও যাই?
পিপুল বলল, না না, যা, আমার দেরি হবে।
======
পিপুল হরিশের কাছে এসে দাঁড়ালো। হরিশ জামার বোতামগুলো খুলে গাছের নীচে যে বাঁধানো জায়গাটা আছে সেখানে বসে আছে। হাতে একটা সরু কঞ্চি। মোষগুলো চরছে এদিক ওদিক।
পিপুল বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। বলল, বাবা, পাঁচটা টাকা দেবে, পেপ্সি খাব।
গরম পড়েছে আজ। ভ্যাপসা গরম। হরিশ বলল, দেব, তুই মোষগুলোকে এইদিকের মাঠে নিয়ে চলে আয় তো।
এই কাজটা করতে হবে শুনে খুশি হয়ে গেল পিপুল। পিঠের ব্যাগটা বাবার কাছে রেখে, বাবার হাত থেকে কঞ্চিটা নিয়ে দৌড়ালো। হ্যাট হ্যাট করে মোষগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছালো। মোষগুলো তাদের এই খুদে মনিবকে পছন্দই করে। কারণ নতুন কবিতা, নতুন খেলা, নতুন গল্প, যাই তাদের মনিব প্রথম শোনে, তারই প্রথম শ্রোতা হয় তারা। তাদের এই খুদে মনিব খাটালের এ মাথা ও মাথা পায়চারি করতে করতে তাদের কবিতা শোনায়। পড়ায়। নতুন খেলার ছক বেঁধে তাদেরই সামনে খেলে। অগত্যা মনিবের হাতে কঞ্চি, বা তার “হ্যাট হ্যাট” কোনোটাই উদ্ববেগের কারণ হল না মোষগুলোর। তারা শান্তভাবে মনিবের কথা মেনে, মনিবের কাঙ্ক্ষিত মাঠে এসে ঘাসে মুখ দিল। মনিবও জয়ের হাসি হেসে বাবার হাতে লাঠি ফিরিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে বলল, দাও।
হরিশ লুঙ্গির ভাঁজ থেকে মানিব্যাগ বার করল। একটা পাঁচটাকার কয়েন হাতে দিয়ে বলল, খেয়েই জল খেয়ে নিবি নইলে ঠাণ্ডা লাগবে।
========
পিপুল পাঁচটাকাটা পকেটে নিয়ে বাড়ির উল্টোদিকের রাস্তায় হাঁটা লাগালো। মুদির দোকানে রাখে ছোটো পেপ্সি। হাঁটতে হাঁটতে দেখল তার ছায়াটা কী সুন্দর রাস্তার ধুলো, ইটের উপর দিয়ে বেয়ে বেয়ে যাচ্ছে। সে দাঁড়ালে ছায়া দাঁড়ায়। সে চললে ছায়াও চলে। একবার দাঁড়ায়, একবার হাঁটে। রোদটা ভালো লাগছে। মেঘ হলেই ভয়।
পেপ্সি কিনে পিপুল ভাবল বাড়ি না গিয়ে বড় যে রেলের মাঠটা আছে, ওখানে যাবে। রবিবার ওখানে বড়রা ক্রিকেট খেলে। কী দারুণ জার্সি পরে থাকে। আর বল মারে…. উই আকাশে….ছয়!
মাঠের একটা দিকে গাছের ছাওয়া দেখে দাঁড়ালো পিপুল। পেপ্সিটা জিভে গিয়ে জিভটা, গলাটা ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। কী আরাম! হঠাৎ দেখল, একটা কুকুর সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে। দেখতে দেখতে আরো চারটে কুকুরের বাচ্চা চলে এল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু পেপ্সি কি এরা খায়? পিপুল বলল, শোন, আমি সামনের রোববার তোদের জন্য বিস্কুট আনব। এটা খাস না। ওরা শুনল না। সবাই মিলে তারদিকে তাকিয়ে বলল, ঘেউ ঘেউ।
এরমধ্যে হল কী, কয়েক ফোঁটা পেপ্সি মাঠে যেই না পড়েছে, অমনি ওরা চাটতে চাটতে আবার তার দিকে তাকালো। আবার বলে ঘেউ ঘেউ। পিপুল পেপ্সিটা নিয়ে ভাবতে যাবে কী করবে, এমন সময় উঠল ঝড়। চারদিক নিমেষে ধুলো আর ধুলো। পিপুল দেখল বাচ্চা কুকুরগুলো আর তাদের মা দৌড়াচ্ছে। সেও তাদের পিছনে পিছনে দৌড়ালো। জামা ভিজে গেলে কী হবে। কী কালো মেঘ। কখন এলো?
কুকুরগুলো লাফ দিয়ে পুজো মণ্ডপে এসে উঠল। পিপুলও উঠল। বৃষ্টি নেমে গেছে। বড়রা এর মধ্যেও ক্রিকেট খেলেই যাচ্ছে। পিপুলের হঠাৎ মনে পড়ল, আরে বাবা মোষগুলো নিয়ে কী করবে?
পিপুল হাতের অবশিষ্ট পেপ্সিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, তোরা খেয়ে নে। এই বলে সে মাঠের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে দৌড় লাগালো। বৃষ্টিতে স্নান করে যাচ্ছে সে। নতুন জামা প্যান্ট সব ভিজে যাচ্ছে। তার সারা গা থেকে ঝরণার মত জল গড়াচ্ছে। সে চোখটা মুছছে আর দৌড়াচ্ছে। দু একবার দেখছে ছায়াটা পড়েছে কিনা। নেই।
ওই তো বাবা…. বাবা….. দাঁড়াও…. আসছি….
মোষগুলোর কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ শোনে ভৌ ভৌ….
বাবা বলল, এ কোত্থেকে আনলি রে?
পিপুল ফিরে দেখে তার পিছনে লেজ নাড়ছে একটা বাচ্চা কুকুর। ওই মাঠেরই কুকুর একটা। পিপুল হাত নেড়ে বলল, আর পেপ্সি নেই আমার। কুকুরটা তার পা চেটে, লেজ নেড়ে বলল, ভৌ ভৌ।
মোষগুলো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তাদের খুদে মনিবের নতুন বন্ধুকে দেখছে। সে এখন মনিবের কোলে। মনিব তাকে নিজের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে তাদের বলল, বাড়ি চল।
মোষগুলো বড়দীঘির পাশ দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল। তার পিছনে খুদে মনিব, তার কোলে তার নতুন বন্ধু, পিছনে হরিশ। দীঘির বৃষ্টি ঝরা জলে সবার ছায়া পড়েছে। মেঘের ছায়া আর তাদের ছায়ায় মাখামাখি।
পিপুল বলল, তোর নাম কী বল তো…. পেপ্সি….
জামার মধ্যে থেকে সে বলল, ভৌ।