Skip to main content

 

তার এক হাত কাটা। আরেক হাতে একটা ইটের টুকরো প্ল্যাটফর্মের ভাঙা সিমেন্টে ঠুকছে। গাইতে পারে না। চীৎকার করতে পারে না। জোরে ডাকতে পারে না। দুটো পা-ও সবল না। ধীরে ধীরে কথা বলতে পারে। কী বলে, সে নিজেই জানে। তবে বলে। শুনবে কে?

সকাল থেকে বৃষ্টি হল কয়েক পশলা। সে ভিজল। রোদ উঠল। জল গায়েই শুকালো। ছোটো স্টেশান। লোকাল ট্রেন দাঁড়ায় উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে, আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে যেতে। লোক নামে ওঠে। সে জোরে জোরে ইটের টুকরো ঠোকে। কয়েকটা খুচরো পয়সা পড়ে, আবার পড়েও না।

তার কেউ নেই। তার নিজেকে নিয়ে নিজের একটা বোধ আছে শুধু। রাতে এই স্টেশানেই যখন স্টেশান মাষ্টারের ঘরের পাশে একটা কোণায় শুতে যায়, সব দুঃখ, শোক, সুখ সেই বোধের কাঁথায় কুণ্ডলী পাকিয়ে মাথার পাশে রাখে। রেললাইনে ট্রেন গেলে যেমন ওঠাপড়া চাপ হয়, তার বুকের মধ্যেও হয়। এটা কষ্ট। এটা সে। সে একা। তার সব কষ্টরা একা। আনন্দরা একা।

ওর জীবনে তেমন কিছু ঘটেনি যা নিয়ে গল্প লেখা যায়। হ্যাঁ, যদি একদিন রেলে কাটা পড়ত, কিম্বা কোনো অসামাজিক কাজ করত, বা হঠাৎ লটারিতে দশলাখ টাকা পেত…..নাহ্‌! তেমন কিছুই ওর জীবনে ঘটেনি। কয়েকটা ছোটোখাটো এটাসেটা ঘটেছে। যেমন যেখানে ও বসে, তার পাশেই যে বিরাট গাছটা আছে, সেই গাছে ভীমরুলের চাকে কটা ছেলে একদিন ঢিল মেরে পালিয়ে গিয়েছিল। এমনিই। ওকে কামড়িয়েছিল ক'টা। জ্বরে বেহুঁশ পড়েছিল প্ল্যাটফর্মেই। কেউ খোঁজখবর নেইনি তেমন। দু একবার এ সে নাড়িয়ে দেখে গেছে, নাড়ি চলছে কিনা, শ্বাস পড়ছে কিনা। কৌতুহলে। আবার সে সেরে উঠেছে। প্ল্যাটফর্মে ইটের টুকরো ঠুকতে ঠুকতে ভিক্ষা চেয়েছে, এক হাতে।

আরেকবার, এই গ্রামেরই এক নেতাগোছের লোকের জামাই নেমেছে ট্রেন থেকে। টিকিট কাটেনি। এ স্টেশানে নামতে টিকিট লাগে না যদিও, কারণ টিটি এক যুগে একবার আসে কিনা সন্দেহ। তো দুর্ভাগ্য, সেদিন টিটি ছিল। নেতার জামাইকে ধরেছে। শ্বশুর স্টেশানেই দাঁড়িয়েছিল। বেগতিক দেখে টিটিকে কয়েকবার “স্যার স্যার” বলেও দেখল। কিন্তু সে তো ভোলার নয়। বলে, হয় ফাইন দাও, নয় জেলে চলো। প্রায় হাতাহাতি হতে হতে জামাই রাগের চোটে টিটির কলার যেই না চেপে ধরেছে, টিটি এক থাপ্পড় এমন মারল যে পাশে শ্যাওলা ধরা হিসি করার জায়গায় গিয়ে পড়ল। অমনি আমাদের গল্পের মানুষটার হাসি পেয়ে গেল, আর হেসেও ফেলল। নেতা আর জামাই দুজনেই কটমটিয়ে তাকালো। যদিও বেশিক্ষণ না। ওদিকে টিটি তো বড় অঙ্কের বিল ধরিয়ে দিয়েছি ততক্ষণে। শুধু তাই না, উঁচু জায়গায় অভিযোগ করবে বলেও শাসাচ্ছে। যা হোক, ওরা রফা করে তো বাড়ি গেল। কিন্তু দুদিন পরেই সন্ধ্যের দিকে, মদ খেয়ে এসে নেতার জামাই আর তার কজন সঙ্গী, কী মার মেরে গেল। কিন্তু মরল না সে।

এসব ঘটনা তার মনে পড়ে না। যেটা মনে পড়ে সেটা ভাদ্রের সেই ঘটনাটা। একদিন রাতে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে হরিদা এল। হরিদার স্টেশানেই চায়ের দোকান। তার কাছে এসে উবু হয়ে বসল। প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। স্টেশান মাষ্টারের ঘরের সেই এক কোণাতেই নিজের কাঁথাব্যাগ জড়ো করে তার সংসার পাতা। হরিদা চারদিক ভালো করে দেখে তার কানের কাছে এসে বলল, কেউ নেই এদিকে, মাষ্টারও খেতে গেছে, আমি এই সুযোগটারই অপেক্ষা করছিলাম, তুই বাঁচা আমাকে। বলতে বলতে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট তার মাথার কাছে রাখা চটের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বলল, এতে কিছু টাকা আছে, আমি বাড়িতে রাখতে পারব না। আমার বড়ছেলেকে তো জানিস, ঠিক হাতে পড়বে। এত রাতে টাকাগুলো হাতে এল, আমি কোথায় রেখে যাব বল? আমাকে দুদিনের জন্য কলকাতায় যেতে হবে, এই রাতেই। তুই রাখ। তোকে কেউ সন্দেহ করবে না। আমি হাতজোড় করছি….

বলতে বলতে হরিদা হাত জোড় করল। সে হাতটা চেপে বলল, ছি ছি। কিন্তু কত টাকা আছে? হরিদা বলল, এই ধর পঞ্চাশ মত তো হবেই। স্টেশান মাষ্টারের বাইকের আওয়াজ হতেই হরিদা লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল। তারপর হাত নেড়ে আসছি বলে মিলিয়ে গেল বৃষ্টির পর্দা সরিয়ে।

দুদিন ওঠেনি সে। কেউ জানতেও চায়নি। নিজে থেকেই বলেছে, শরীরটা ভালো না। দুদিন পর একই সময়ে আবার হরিদা এসে উপস্থিত। নিজেই ব্যাগ খুলে ছোঁ মেরে টাকার প্লাস্টিকটা নিল। আসলাম রে, বলে চলে গেল। সব কিছু এত হড়বড় করে হল যে কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মত বসে থেকে তার মনে হল তার প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে। হালকাও লাগছে বুকটা।

পরেরদিন সে যখন ভিক্ষা করতে বসেছে, হরিদা এসে চা দিয়ে গেল এক ভাঁড়। ব্যস, ওই প্রথম আর শেষ। তারপর ফিরে তাকাতও না। এমনকি মেয়ের বিয়ে হল, তাকে ডাকল না। মেয়ে জামাইকে ট্রেনে ওঠাতে এল, তার দিকে ফিরেও তাকাল না। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, ওই টাকাটা যতক্ষণ ছিল, তার একবারও ওটা নিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা হয়নি, পালাবার ইচ্ছা হয়নি। নিজের মনের এমন স্বভাবটা দেখে সে নিজের উপর খুশি হয়েছে। এ নোংরা জগতে তার নিজের মনটা তো নোংরা হয়ে যায়নি। কিন্তু এখন তার নিজেকে বোকা লাগছে। ভীষণ বোকা। টাকাগুলো তো দুনম্বরীও হতে পারত। মিথ্যা ফেঁসে যেত। অবশ্য এর থেকে কী খারাপ হত?

এরপর থেকে হরিদাকে দেখলেই তার মনে একটা রাগ আর কষ্ট হয়। বোকা হয়ে যাওয়ার কষ্ট বড় বাজে। একদিন সকালবেলা হরি দোকান খুলতেই সে গিয়ে দোকানের বেঞ্চে বসল। হরিদা ঠাকুরকে ধূপকাঠি দেখাতে দেখাতে তার দিকে আড়চোখে দেখতে লাগল। খদ্দের হচ্ছে ক্রমশ। ভিড় বাড়ছে। তার থেকে দূরেই বসছে লোকজন। হরিদার চোখেমুখে অস্বস্তি রাগ ফুটে উঠছে। তার মনে হয়েছিল হরিদাকে রাগিয়ে তার ভালো লাগবে। কিন্তু ভালো লাগল কই? লাগছে না তো। সে উঠে ধীরে ধীরে আবার আগের জায়গায় এসে বসল। দূর থেকে হরিদাকে দেখতে লাগল।

এটা অভ্যাস হয়ে গেল। রোজ বসে বসে হরিকে দেখে। হরির শরীর ভেঙে পড়া। গাল তুবড়ে যাওয়া। ঝুঁকে যাওয়া সব দেখে। একদিন হরি মারা গেল।

সেদিন বিকেলে হরির মেয়ে জামাই যখন হরির নাতনিটাকে নিয়ে স্টেশানে নামল, সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটা বাবার বন্ধ দোকান দেখে কাঁদল। তারও কান্না পেল। বুক মোচড় দিয়ে আরেকটা কী একটা কষ্ট হল যেন। সে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে গিয়ে স্টেশান মাষ্টারের ঘরে ঢুকল। বলল, স্যার, ওই বাচ্চা মেয়েটাকে একটা লজেন্স কিনে দেবেন? আমি টাকা দেব। ও হরিদার মেয়ে। আমি দেব না, ভিখারির হাত থেকে কি ওরা নেবে? আপনি দেবেন? আমি টাকা দেব….আমি টাকা দেব। বলতে বলতে তার চোখ উপচে জল এল। কই অভিমান? কই? সেই একটা মানুষই তো তাকে এতটা বিশ্বাস করেছিল। সে-ই নির্বোধের মত তারই কাছে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান আশা করেছিল। বোকা তো সে নিজেকেই নিজে করেছে। ছি ছি! হায় রে, হায়! কী ভিখারি মন তার!