Skip to main content

 

ট্রেনটা বিশাখাপত্তনমে কুড়ি মিনিট দাঁড়াবে। বিকেল এখন। গরম ছিল সকাল থেকে। এই খানিক আগে বৃষ্টি হল কয়েক পশলা। প্ল্যাটফর্মের শেষে দাঁড়িয়ে মাটির সোঁদা গন্ধ পাচ্ছি। এ গন্ধের জন্য দায়ী একটা ব্যাকটেরিয়া। তার গায়ের রাসায়নিক বস্তু। জিওস্মিন। কী দারুণ নাম না? হ্যাঁ, এর জন্যেই এই গন্ধ। কত কী লেখা হয়ে গেল এই সোঁদা গন্ধ নিয়ে। অথচ একটা ব্যাকটেরিয়ার জন্য এত কিছু।

ট্রেনে আমার অসুস্থ বাচ্চা শুয়ে। পাশে ওর মা। ওর শরীরেও কোনো মারণ জীবাণু ঢুকে। সে জিওস্মিন জানে না। ও বাঁচবে না। ওর মা আশা করে ভেলোরে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার আশা দেয়নি। আমি চিন্তা করি না। কোনো কিছুই চিন্তা করি না। চিন্তা কিচ্ছু দেয়নি। কেড়েছে সব। সব কিছু। এমনকি আমার বাচ্চাটার যে ক'টা মাস বাকি আছে সে ক'টা মাসকেও আমি দুশ্চিন্তায় বিষাক্ত করে তুলছিলাম। ওর কী দোষ? যেতে তো হয় সবাইকেই। কেউ আগে। কেউ পরে। যাক। কিন্তু কী দিলাম ওকে? আমি ভাবি না আর। আর ভাবব না। আমি যখন ট্রেনের দরজা দিয়ে নামলাম, ওর জানলার পাশ দিয়ে আসছিলাম, ও জানলার রড ধরে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। তখন বৃষ্টি নামছে ঝেঁপে। আমি ওর দিকে তাকালাম। হাসলাম। ভিতরে চৌচির হতে হতে হাসলাম। হাঁটলাম। প্লাটফর্মের এই প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। ওই যে পাহাড়গুলো, আমাকে বলছে, সব ফাঁকি। আমি জানি। কিন্তু আমি চিন্তা করি না আর। আর না। ট্রেন কাল হাওড়া পৌঁছাবে। আমি, আমার স্ত্রী আর বাচ্চাটা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে গলির মধ্যে আমাদের পনেরোদিন অন্ধকারে ফেলে যাওয়া ঘরটায় ঢুকব। তারপর?

ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে। এবার ফিরি। মাটির গন্ধে আমার নিজের ছোটোবেলা মনে পড়ছে। আমার ছোটোবেলা শ্যামনগরের একটা গ্রামে কেটেছে। বাবা পোস্টমাস্টার ছিলেন। মায়ের কথা মনে নেই। বাবা আত্মহত্যা করেন। আমি তখন কলেজে। আগে রাগ হত। এখন হয় না। হয় তো বাবাকে বুঝি আমি এখন। হয় তো সব মানুষকেই বুঝি আমি এখন। জীবন সব দেয় না। কাড়াকাড়ি করলেও না। সবাই মেনে নিতে পারে না।

এখনও গন্ধটা আসছে। জিওস্মিন। ব্যাকটেরিয়া আমাকে সুখ দিচ্ছে। বাঁচার জন্য প্রলোভন জাগাচ্ছে। অবাঞ্ছিত সুখকে নিয়ে কী করে মানুষ? সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য - দুই-ই অবাঞ্ছিত হলেই আঘাত করে। নয় সুখে, নয় যন্ত্রণায়। জীবন তুমি আমায় আরো আরো আঘাত করো, অবাঞ্ছিত হয়ে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, জীবনের পর জীবন।

ট্রেনের ইঞ্জিন চেঞ্জ হল। এবার ছাড়বে। আর পাঁচ মিনিট বাকি। আমি যদি আর না উঠি? যদি নিরুদ্দেশ হই এখান থেকেই। সব বদলে যাবে?

আমি হাঁটছি। আমাকে এস সিক্স অবধি যেতে হবে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক দীর্ঘ কালো পথ। তারপর আমি আর আমার স্ত্রী বেঁচে থাকব। দিনের পর দিন যাবে। আমাদের একা থাকা, আমাদের দোকা থাকার মধ্যে লাট্টুর মত ঘুরবে। আমাদের ধীরে ধীরে ছিন্ন করবে। আমি হাঁটছি, আমি এস সিক্সে পৌঁছালাম। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমার নাকে এখনও লেগে জিওস্মিনের গন্ধ। ভিজে মাটির, প্রথম বৃষ্টির উপহার। আমি সে উপহার আনতে পারিনি ওদের জন্য। সে গন্ধকে ওখানেই রেখে এসেছি। পৃথিবীর যা কিছু পৃথিবীকেই ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হয়। এত শোক, কে নেবে আমার? আমার স্ত্রীর? আমি কি জগত ছাড়া? হা ঈশ্বর!

বাচ্চাটা ঘুমিয়ে। স্ত্রী কাগজের চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তোমায় খুঁজছিল….বলছিল…পাপ্পা কি হারিয়ে গেল?

আমার স্ত্রীর দুই চোখ জলে ভরে এল। আমার ঝাপসা দৃষ্টিতে আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চায়ের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল। আমার মায়ের কথা মনে পড়ল। না দেখা মাকে। ট্রেনে ধাক্কা লাগল। ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে আমার ক্ষণিক আগে কাটা মুহুর্তকে। আমার সোঁদা গন্ধকে। ব্যাকটেরিয়াকে। জিওস্মিনকে। ট্রেনের আঘাতে আঘাতে আমার না দেখা মা বুকে জেগে উঠল। মায়ের কপালে বড় সিঁদুর। স্পষ্ট মুখ। যেন আজই সদ্য বাবা কাঁচ মুছে দিয়েছেন ছবির। মা তাকিয়ে আমার দিকে। আমার কান্নার দিকে। আমার অসহায়তার দিকে। আমার সব কথা বুঝে যাচ্ছে মা। আমার শুষ্ক হৃদয়ে, আমারই চোখের জল বিন্দু বিন্দু পড়ে ডেকে আনল মাকে, আমার বুকের মধ্যে জাগা জিওস্মিনকে। আমি আমার সন্তানের কপালে চুমু খেলাম। যাক নিয়ে ওকে মহাকাল, যাবেই যখন যাক। কিন্তু মহাকালও কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না ও ক্ষণকালের জন্য হলেও আমার সন্তান হয়ে এসেছিল। আমাকে ভালোবেসেছিল। আমিও ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসবও। যতদিন বেঁচে থাকব, ও নাই বা থাকুক….. ও থাকবে পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা জিওস্মিনের মত….বৃষ্টিই যাকে জাগাতে পারে শুধু…..