Skip to main content

 

সারাদিন নগরকীর্তন করে এসে বোষ্টমির আজ একশো টাকাও হয়নি। এত বৃষ্টি, এত বৃষ্টি। নগরকীর্তন তো না, ভিক্ষা।

বোষ্টমির ইচ্ছা ছিল আজ কিছু টাকা হলে একটা ব্লাউজ বানাতে দেয়। কিন্তু হল কই? বাইরে যাওয়া, আশ্রমে পরার ব্লাউজ বলতে তিনটে। দুটো তো একদমই বাইরে পরে যাওয়া যায় না। এটা তাও বা যায়।

আশ্রমে ফিরে কাদা পা কল চেপে ধুতে ধুতে কান্না পেয়ে গেল। কেঁদেই ফেলল। তুমুল বৃষ্টি বলে কেউ খেয়াল করল না তার গাল বেয়ে যে জল গড়াচ্ছে, সে আকাশের সাতসমুদ্রের জল না, নিতান্ত মাটির হৃদয়ের।

আশ্রমের বারান্দায় বুড়ো বোষ্টমি চৌকি পেতে শুয়েছিল। সেখান থেকেই সে হাঁক পেড়ে বলল, আরে জ্বর হয়ে মরবি নাকি রে মা…..এই বৃষ্টিতে তোর পায়ে কী এমন কাদা লাগল…ও তো আকাশের জলেই ধুয়ে যাবে।

বোষ্টমি কানে নিল না। খালি পায়ে নগর ঘোরে। না ধুলে মনটা খুঁত খুঁত করে। নিজের ঘরে এসে শতচ্ছিন্ন ব্লাউজটা পরে, বাইরের শাড়িটা ছেড়ে, রোজকার শাড়িটা পরে জপের মালা নিয়ে মন্দিরে বসল। কান্না আসছে বুক ঠেলে। গোবিন্দ, পুরুষ করেছ সংসার জুড়ে, পুরুষের চোখে ইটভাটার আগুন জ্বালিয়েছ দিনরাত। আমাদের ব্যবস্থা করতে পার না?

আঙুল ঘুরে যাচ্ছে নিয়মমত। একশো আটবার হয়ে গেলে মালাও ঘুরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু মন ঘুরছে কই? মালতী বৌদির কথা মনে পড়ে আরো বুকটা জ্বলে গেল। প্রত্যেক বছর তিনটে কী চারটে করে ব্লাউজ দিত। সাদা ব্লাউজ। বলত, তুমি ছুপিয়ে নিও গেরুয়ায়। বছর ঘুরে ভিক্ষা করতে গিয়ে শোনে করোনা তাকেও নিয়েছে!

প্রসাদের ডাক পড়ল। বোষ্টমি উঠল না। কেউ সাধল না। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। গোবিন্দ আর শ্রীরাধা আশ্রমের দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। বোষ্টমির চোখ লেগে আসছে ঘুমে। কান্নায়, হতাশায়, ক্লান্তিতে আশ্রমের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েই পড়ল।

বৃন্দাবনের ঘাট। শ্রীরাধিকা সখীদের সঙ্গে কিনছেন ব্লাউজ। কী সব রঙ! ফেরিওয়ালা বলছে, বাকিতে দেব না কিন্তু, দাম দাও আর নাও। সব গোপীরা দরদাম করছেন। শ্রীরাধিকা ব্লাউজ দেখতে দেখতে আনমনা। বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন। দেখতে দেখতে আকাশ কালো করে এল মেঘ। গোপীদের ব্লাউজ কেনা হয়ে গেছে। শ্রীরাধিকাকে ফেরিওয়ালা বলছে, কী গো তুমি নেবে না? তাড়াতাড়ি নাও, বৃষ্টি এলে আমি এক মুহূর্ত দাঁড়াব না। নাও নাও….তাড়াতাড়ি করো….

শ্রীরাধিকা বললেন, তুমি যাও….শ্রীগোবিন্দের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে বোলো, আমি এখানে আছি, এখানেই অপেক্ষায় আছি….মেঘ এলেও…

হঠাৎ ঘটাং করে আওয়াজ। বোষ্টমি চমকে তাকাল। বেড়াল ঢুকেছে। কোশাকুশিগুলোতে ধাক্কা লেগেছে ওর পায়ের। ছি ছি, ভাগ্যিস বেড়াল ঢুকেছিল। অন্য কেউ যদি এসে দেখত সে ঘুমাচ্ছে…ছি ছি। তাড়াতাড়ি মালাটা প্রণাম করে বোষ্টমি বাইরে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধা চৌকিতে শুয়ে শুয়ে বলল, হ্যাঁ লো….খেলি না কেন? শরীর খারাপ? এদিকে আয় দেখি……

ছোটো বোষ্টমি পাশে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল। বৃদ্ধা তার কপালে হাত দিয়ে বলল, তাপ কমেছে তো রে। এত অভিমান ভালো না। কীসের এত অভিমান। আমায় বল।

বোষ্টমি হেসে, কিছু না বলেই বৃদ্ধাকে প্রণাম করে নিজের ঘরে এসে বসল। মনের তাপটা কেটেছে। বাইরে বৃষ্টি ধরেছে। অভাব তো আছেই। কিন্তু কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল না হয় পরশু ঠিক হবেই। ঘরে প্রসাদী দুটো কলা ছিল। সে দুটো খেয়ে বাইরে ছিলকাটা ফেলতে যাবে, দেখে একজন ছাতা মাথায় সাইকেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মধ্যে পালপাড়ার বোষ্টমি কে গো?

সে এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি। কেন?

সে বলল, কাল আমার মায়ের কাজ, তোমাকে আর সেঁজুতি আছে না, ওই যে গো তোমাদের এখানে ছেলে নিয়ে থাকে, বিধবা, ওকে নিয়ে এসো। বাবা বলেছেন। তুমি নাকি ভীষণ ভালো কীর্তন গাও। এসো।

মনটা দপ করে জ্বলেই আবার নিভে গেল। গেলে কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু কী গায়ে যাবে?

অমনি তার কী এক পদ উথলে উঠল বুক ছাপিয়ে….

“মাধব তুয়া অভিসারক লাগি

দূতর পন্থ গমন ধনি সাধয়ে

মন্দিরে যামিনি জাগি।।

গুরুজন বচন বধির সম মনই

আন শুনই কহে আন।।”

আমন্ত্রণ কর্তা ছাতা মাথায় ফিরে গেল। বোষ্টমি তার চলে যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে ভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার পায়ের আঙুলগুলো নেচে উঠল। সে গেয়ে উঠল। তখন মেঘ ছেঁড়া বিকেলের আলো এসে পড়েছে আশ্রমের উঠানে। বোষ্টমি নাচছে। একাই। সারা আকাশ মেঘ আর পড়ন্ত রোদ নিয়ে তার দিকে বলছে, কাল যাস কিন্তু! আমরাও যাব।