Skip to main content

 

কিছু জীবন বাজে খরচের জন্যই তৈরি হয়। তারা অপরাধী নয়। হয় তো অসামাজিক, তা বলে সমাজবিরোধী নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে সমাজই তাদের বিরোধী। সে কিছু মনে করে না তাতে। কষ্ট লাগলেও না।

সেই বাজে খরচের জীবনে মাঝে মাঝে ফুল ফোটে। অকারণে। বিনা যত্নে। কেউ কেউ এসে জিজ্ঞাসা করে, কী ফুল এটা?

সে কী করে জানবে কী ফুল? সে কি ইচ্ছা করে ফুটিয়েছে নাকি? সে বলে, জানি না।

তারা গোঁসা করে বলে, বেশ, কোথা থেকে পেলে এ গাছের বীজ, কী মাটি দিলে, সার দিলে সে সব তো বলবে?

সে আবার বলে, জানি না তো।

তারা শাপশাপান্ত করে তাকে মারতে বাকি রাখে। বলে, অহংকার এত! এই ফ্যালফেলে জীবনের এত গুমোর!

তারা সহ্য করে নেয়। আর কী-ই বা করবে।

এমন বাজে খরচের জীবনের দায় অনেক। একে তো সঞ্চয় নামমাত্র। তায় খরচের হিসাব নেই। কোথা থেকে আসে, কোথা দিয়ে যায়, কোনো পাকাখাতা নেই লিখে রাখার। হবে কী করে? জীবনে তার পাকা আছেটা কী? এক মরণের রঙ ছাড়া? কিন্তু সে রঙ তার অভিমানের রঙ না। সে তার অভিসারের রঙ।

এমন বাজে খরচের মানুষকে অবজ্ঞা করতে হয়। নইলে সমাজ টেকে না। ব্যবসাবাণিজ্য ভেসে যায়। আর ব্যবসাবাণিজ্য ভর করে তার যাবতীয় যা কিছু, যেমন শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান-ধর্ম ইত্যাদি ইত্যাদি সব ভেসে যায়।

তবে অবজ্ঞার প্রাচীরের ওদিকেই ওরা থাকুক। মরবে না ওরা, সে ভয় নেই। যাদের মান-অপমান বোধ নেই, তারা অমন কথায় কথায় মরে যায় না, এই এক রক্ষে। একবারই মরে। নিঃশব্দে।

তবে মাঝে মাঝে সে পাড়া থেকে পাঁচিল ডিঙিয়ে বদ হাওয়া এসে এপারে লাগে। শিহরণ জাগে গায়ে। হঠাৎ করে সব সঞ্চয়কে মনে হয় মাটির ঢেলা, নিজের হাতে গড়া স্বপ্নের ইমারতকে মনে হয় কারাগার, যা কিছু প্রাপ্তিকে মনে হয় ছেলেখেলা, সব সম্পর্ককে মনে হয় দাবার ছকের মত সাজানো লাল কালো ঘুঁটির চাল। সঙ্গে সঙ্গে বিপদসঙ্কেত বেজে ওঠে। পাঁচিলের উচ্চতা বাড়ানো হয়। শুদ্ধিকরণ ব্রতের আয়োজন করানো হয়। সমাজের বরিষ্ঠ পুরোহিত বড় মানচিত্র নিয়ে আসেন। বাজে-খরচ মানুষের হাওয়া লেগে বিকার লেগে যাওয়া মানুষের সামনে সে মানচিত্র মেলে দিয়ে বসেন। সে মানচিত্রের একটা বিন্দুতে তর্জনী রেখে বলেন, এই…ঠিক এইখানে তুমি আছ….সমাজ কত তলা সে আন্দাজ আছে? কত তলা ওঠা বাকি জানো? কত বয়েস হল? সে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যদি ছন্দ মেলাতে না পারো জবাব দেবে কী করে?

বিকারগ্রস্ত মানুষ অনেক কিছু বলতে চায়। তারই তো জীবন…কাকে জবাব দেবে? কেনই বা দেবে? কিন্তু পারে না। তার ভাবের সঙ্গে ভাষা মেলে না। অভ্যাস নেই যে। ভাষা জিভে নামে মাথার মধ্যে থেকে কালো কুঠুরির লক্ষ সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে। আর ভাব? সে হৃদয়ে জন্মে, অপুষ্ট দুর্বলতায় সম্মোহিত হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নেয়। সে মৃত শরীরে ভারে হৃদয় ন্যুব্জে পড়ে। তার জিভ শুধু নেশাগ্রস্তের মত বলতে থাকে, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে…ঠিক আছে… ঠিক আছে….আর ভুলব না….সব বুঝেছি….সব সব সব।