মা, চুল আঁচড়াওনি কেন?
বৈশাখের বিকেল। আকাশে শ্রাবণের মেঘ। বৃদ্ধা দরজার চৌকাঠে বসে। সাদা শাড়ি গায়ে। শাড়িটা জীর্ণ। তার পাশে বসে মেয়ে। বয়েস হয়েছে পঞ্চাশের কোঠায়। পাশে বসে। বাঁ হাতটা দিয়ে মায়ের মাথায় চুলের মধ্যে আদর করছে।
মা বলল, আজ দুপুরে স্নানের পর তোর বাবা বলল, যুথিকা রায়ের “ঘুঙ্ঘট কা পট খোল রে” মনে আছে? গাইবে? আমি গাইলাম। গাইতে গাইতে এমন কালো করে মেঘ করে এলো। তোর বাবা বললেন, তোমার গলায় এখনও কী যাদু আছে গো। দেখ আকাশও সজল হল।
মেয়ে মায়ের গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে বলল, তুমি নিজেই তো যাদু।
মা বলল, শোন না, আমি গাইতে গাইতে হঠাৎ দেখলাম তোর দাদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। স্পষ্ট দেখলাম রে মণি। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির। যেন খিদে পেয়েছে। আমি গাইতে গাইতে ইশারা করলাম, ঘরে আয়। ঠিক তখনই ঝড় উঠল। পুকুরের দিকের জানলাটার তো হাওয়াঠেস নেই। ধড়াম করে পড়ল। আমি চমকে উঠে কেঁদে ফেললাম। তোর বাবার বুকের উপর মাথা রেখে। মানুষটা তো হাত পা নাড়াতে পারে না বল, সে কী করে আমার মাথায় হাত রাখবে? আগে যেমন করে রাখত। আমি ওর হাতটা নিয়ে আমার মাথায় রাখলাম। তোর বাবা বলল, বাবু এসেছিল না? দরজার কাছে আজও দাঁড়িয়েছিল? বাবু তোমার গান শুনলেই আসে। মেঘের মত। ও তো মেঘের দেশেই আছে বলো।
মেয়ে মায়ের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে। দমকা হাওয়ায় এক ঝাঁক কৃষ্ণচূড়া পড়ল মা আর মেয়ের মাথায়, বুকে। মেয়ে বলল, মা!
মা বলল, তোর বাবা ঘুমিয়ে পড়ল। আমি তোর বাবার হাতটা আমার মাথা থেকে নামিয়ে ওর বুকে রেখে উঠে বসলাম। দরজার কাছে এসে ঝুঁকে দাঁড়ালাম। বাবুর পায়ের ছাপ যদি থাকে। ছিল না। এক সার পিঁপড়ে উঠছে দরজার দরজার ধার বেয়ে। আমি শুনলাম বাবু বলছে মা, বৃষ্টি আসছে। ছাদে বাবার লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর তোমার দুটো শাড়ি মেলা আছে। যাও যাও। আমি পারব না, আমার হাওয়ার হাত, জলের শরীরে, কিছু ধরে রাখতে পারি না।
মেয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা….বড় ভালো ছিল…. না মা?
মা বলে চলল, জানিস ছাদে উঠছি, শেষ সিঁড়ি ওঠার আগেই দমকা হাওয়ায় ছাদের দরজাটা খুলে দিল, তোর দাদা….
মা, চলো ভেতরে যাই। মা….চলো, বাবাকে হরলিক্স গুলে দেবে। সন্ধ্যে দেবে। চলো।
মা ঘরে এলো। বাবা বলল, আগে সন্ধ্যে দিয়ে নাও। তারপর আমাকে হরলিক্স গুলে দিও। মা বলল, তুই কি মুড়ি খাবি রে মণি?
মেয়ে বলল, বাড়ি যাই, তোমার জামাই চলে আসার সময় হয়ে যাবে নইলে।
মা বলল, আগে সন্ধ্যেটা দিয়ে দিই, তারপর যাস।
মেয়ে বলল, আমি তবে বাবার কাছে বসি। তুমি এসো।
মা বলল, আচ্ছা। বাবা বলল, তুমি সন্ধ্যে দিয়ে এসো, আমি ঠাকুরের নাম করি। মা বলল, আচ্ছা।
বাইরে বৃষ্টি দমকে দমকে হচ্ছে। মা ঠাকুরের সামনে বসে। প্রদীপ জ্বালাতে চাইছে। বারবার নিভে যাচ্ছে। মা বলছে, বাবু দুষ্টুমি করিস না….বাবা তোর দিদি আর বাবা অপেক্ষা করছে…..
প্রদীপ জ্বলে উঠল। শিখা কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে বলল, মা….মা…আমার মা। মা মাথাটা ঠাকুরের সামনে মেঝেতে ঠেকালো। গলায় আঁচল জড়ানো। মাথাটা তুলে জোড়হাতে ঠাকুরকে প্রণাম করল। উঠে দরজার কাছে এসে আবার ফিরে তাকালো। কাউকে একা রেখে যেতে মায়া লাগে, ঠাকুরকেও। ঠাকুরকে বলল, আমি রাতে খাওয়ার পর আসব। একা রাখব না। বড় কষ্ট, বুঝি। বাবুকে বলল, চল, মণিকে ছেড়ে আসি।
একটা দমকা হাওয়ায় আঁচলটা উড়ে গিয়ে আবার শান্ত হল। মা বলল, চল চল। আছি আছি। যাচ্ছি না কোথাও।