মানুষটা চড়াই, শালিক, কাক তাড়ায়। তার কোমর ভাঙা। উঠতে পারে না। চলতে পারে না। খোলা উঠানে, আকাশের নীচে খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে, রাতদিন বলে, হুস হুস। হুস হুস করতে করতে চোখ লেগে যায়। আকাশে ওড়া পাখিকেও বলে, হুস। চাঁদকেও বলে, হুস। সূর্যকেও বলে, হুস। মেঘকেও বলে হুস। এক একদিন নীল আকাশটাকেও বলে, হুস।
একদিন গরু চরাত। কাঠ কাটত। চাষ করত, এর ওর ক্ষেতে। দুটো পয়সা হতে বিয়ে করল। বাচ্চা হল। কিছু মরল, কিছু বাঁচল।(তখন গ্রামে ডাক্তার কই? এখন তো ছোটো হাসপাতাল আছে।)। তাদের বড় করতে ভ্যান টানল, মড়ার জামা-খাটের লেনাদেনা করল, মদ বেচল, বোমা-বারুদ নিয়ে ভোট ভোট খেলায় খেলল। কিছু টাকা জমল। এ বাড়িটা বানালো। বাড়ির ছাদ ঢালাই হল যেদিন, সেদিন বিকেলে ছাদে জল দিতে গিয়ে, জমা জলে আকাশের সামনে তার যে ছায়া পড়ল, সে দেখল সে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করেনি। কে এটা?
ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসার করে দিল। কেউ কেউ সংসার করল। কেউ ভাঙল। কেউ পালালো অন্য কারোর সঙ্গে। তার বউ মরল একদিন ভুল ব্যাঙের ছাতার তারকারি খেয়ে। সেও মরত। দুজনেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। কিন্তু সে ফিরে এল।
এখন বাড়িতে তার ছোটোছেলের বউ আর সে। ছোটোছেলে বাড়ি আসেই না প্রায়। মদ খেয়ে এদিক ওদিক পড়ে থাকে। ছোটোছেলের ছেলেমেয়ে নেই।
প্রচণ্ড গরমের দিন। রাস্তার কুকুরগুলো অবধি ছাওয়া ছেড়ে বেরোবার সাহস দেখাচ্ছে না। ছেলের বউ বাড়ি নেই। কেউ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ারও নেই। উঠানে কয়েকটা শুকনো পাতা গরম বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষটার ঘাম হচ্ছিল খানিক আগে অবধি। এখন আর হচ্ছে না। জিভটা শুকিয়ে কাঠ। চাঁদিফাটা রোদের তাপ তার কালো কপালের উপর পড়ে। দুটো হাত পা অবশ। নাকের উপর অনেকক্ষণ পরে একটা মাছি বসেছিল। নাকটা একবার কুঁচকে, দুটো হেঁচকি তুলে শরীরটা নিথর হয়ে গেল। মাছিটা চমকে কিছুটা উড়ে, কয়েক পাক ঘুরে এবার এসে ঠোঁটের উপর বসল। ঠোঁট প্রতিবাদ করল না।
রোদ পশ্চিমের দরজা খুলে ফেরার পথে। কয়েকটা চড়াই, কাক, শালিক এসে উঠানে বসেছে। বারবার তাকাচ্ছে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। শুনতে চাইছে, হুস হুস। সন্ধ্যে হব হব। তাদের ফেরার পালা। তাদের ছায়া বড় হচ্ছে। মানুষটা আর খাটের ছায়া বড় হতে হতে বেড়া ছুঁলো। ছেলের বউ ফিরল। বলতে বলতে ঢুকল, আমি চা বসাচ্ছি…আজ দেরি হল, ওদের বাড়ির বাচ্চাটা আসতে দিচ্ছিল না। অন্যদিন হলে বৃদ্ধ বলত, আহা…আহা…তোর যদি একটা বাচ্চা হত….আমার ছেলেরই দোষ….মদ খেয়ে…..
আজ উত্তর দিল না কেউ। ঘরে ফেরার পাখির আওয়াজ শুধু উঠান জুড়ে।