রামলাল ওঝা, বয়েস আশি ছুঁই ছুঁই, এগারোটা কাগজের চায়ের কাপ, আর এক কেটলি দুধ চা নিয়ে যখন মন্দিরে ঢুকল তখন কীর্তন শেষের পর্যায়ে। রামলাল একটা কোণে গিয়ে বসল। প্রতি শনি মঙ্গলবার হনুমান মন্দিরে কীর্তন হয়। রামলালের মনে পড়ে না কবে থেকে আসছে।
রামলালের বউ ছিল, ছেলে ছিল, ছেলের বউ ছিল, নাতি ছিল। এখন কেউ নেই। রামলাল একা দুটো ঘর নিয়ে থাকে। একটা ঘরে ঘুমায়, আরেকটা ঘরে রান্না করে, খায়, বিশ্রাম নেয়, গীতা রামায়ণ পড়ে। তার বাড়িতে শেষ কবে কেউ এসেছে মনে পড়ে না।
কীর্তন শেষ। সবাইকে চা দিয়ে নিজে নিল রামলাল। গল্প করছে অনেকে। কেউ চুপচাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছে। রামলালের থেকে অনেকেই বয়সে ছোটো, কেউ কেউ তার সমবয়সী, রেলের কারখানা থেকে একসঙ্গে রিটায়ার করেছে।
সবাই উঠে যাচ্ছে। রামলাল ফাঁকা কেটলিটা নিয়ে চায়ের দোকানে দিতে এলো। বেঞ্চের উপর রেখে বলল, রেখে গেলাম রে কার্তিক….দোকানের ভিতর থেকে উত্তর এলো, আচ্ছা দাদু….।
এবার ফিরতে হবে। দুটো রুটি দোকান থেকে কিনে বাড়ি ফিরল। ডালটা স্টোভে গরম করে, ডালের মধ্যে রুটি দুটো দিয়ে জপের মালা নিয়ে বসল। হনুমানজীর কৃপা অনেক। শোক আছে। শান্তি আছে। ভয় নেই। সুখ নেই। শান্তি আছে। অশান্তি নেই।
রামলাল বাজার করে। মন্দির ঝাঁট দেয়। বন্ধুরা অসুস্থ হলে দেখা করে। মাঝে মাঝে তীর্থে যায়। কাশী, বৃন্দাবন, গয়া।
একদিন রামলাল চায়ের দোকানে চা নেবে বলে বসে আছে। কীর্তনের আওয়াজ আসছে এখান থেকেও। বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। রামলাল সাদা ধুতি আর ফ্যাকাসে গেরুয়া পাঞ্জাবি গায়ে বসে। একটা বাচ্চা এলো। সঙ্গে ওর মা। দুজনেই ভিজে। দুকাপ চা নিয়ে বসল বেঞ্চে। রামলালের উল্টোদিকে। রামলালের কানে কীর্তনের আওয়াজটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বৃষ্টির আওয়াজটা কানে ফিসফিস করে বলছে, রামলাল ওরা অপেক্ষা করছে…..আয় আয়….সবাই আছে….ওদিকে আছে….আয় আয়। রামলাল জিজ্ঞাসা করল, এ তোমার ছেলে? বউটা মাথা নাড়ল। রামলাল বলল, তোমার বর কী করে? বউটা বলল, ভ্যান চালাত। একটা পা কাটা গেছে। এখন কিছু করে না। রামলাল বলল, আচ্ছা। বাচ্চাটা ভাঁড়ের মধ্যের লেগে থাকা শেষ চাটুকু চাটছে। রামলাল জিজ্ঞাসা করল, বিস্কুট খাবে? খেল। দুটো খেল। রামলালের কানে বৃষ্টির আওয়াজ তার বউয়ের গলার আওয়াজের মত বলল, ওদের রুটি কিনে দাও। রামলাল দিল। উঠতে যাবে, বৃষ্টি তার নাতির মত দুটো হাত ধরে বলল, দাদু ওকে একটা চটি কেনার টাকা দাও, ওর খালি পা। রামলাল দিল। ওরা নিল। রামলাল বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছে। হনুমানজীর কাছে যাচ্ছে। ওদের সবাইকে হনুমানজী আগলে রেখেছে। সিলিণ্ডার ফেটে আগুন লেগেছিল। রামলালের নাইটডিউটি ছিল সেদিন।
বৃষ্টির মধ্যে কাপগুলো ভিজল। ভেজা কাপেই চা দিল। বৃষ্টির ছাঁট ছেলের মত সারাটা শরীরে লেগে বলল, বাবা আমরা ভালো আছি, সময় হলে এসো। রামলাল বলল, আসব আসব। আর তো ক'টা দিন। আসব। ফাঁকা কেটলির মধ্যে লেগে থাকা চায়ের গন্ধের মত সংসারের মৃদু সুখ রামলালের বৃদ্ধ বুকে শিরশির করে জেগে উঠল। বৃষ্টির ছাঁটের চমকে হনুমানজী বলল, বাড়ি যা রামলাল, এখনও সময় হয়নি। হলে নিয়ে যাব।