ধর্ম বহু। ঈশ্বর নানাবিধ। প্রথাও তাই। ভেদ আছে। কিন্তু ভেদবুদ্ধি?
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, সব ধর্ম এক। শিরডির সাঁই বলছেন, সব কা মালিক এক। কিন্তু সমাজ জানে তা নয়। ভেদ আছে। বিদ্বেষ আছে। কারণ ভেদবুদ্ধি আছে। কেন?
কারণ মেটাফিজিকালি সব ধর্ম, সব ঈশ্বর এক হলেও ফিজিকালি তা নয়। জগত চলে ফিজিকালি। মেটাফিজিকালি না।
বহু বিশ্বাস। বহু মত। কিন্তু যত মত তত পথ নয়। বাস্তবে আমার পথই পথ, তোমারটা নয়। আমার দেবমানব আসল। তোমার নকল। আমার ধর্মগ্রন্থ খাঁটি। তোমার ভুল। কারণ জগত চলে মোটা দাগের "আমি" তে ভর করে। ফিজিকালি।
এ গেল ধর্ম। এ ছাড়াও আরো দিক থেকে বৈষম্যর বোধটা মাথা চাড়া দিচ্ছে। বৈষম্য আছেই, কিন্তু তার বোধটা এখন বারুদের কাজ করছে। বৈষম্যের বারুদকে জমিয়ে জমিয়ে তৈরি হচ্ছে মৌলবাদীর দল। শুধু ধর্মে না, চামড়ার রঙ, ভৌগোলিক পরিচয়... সব নিয়ে।
তবে সংহতি, সহিষ্ণুতা শব্দগুলো এত পেছনের সারিতে চলে যাচ্ছে কেন? কারণ মানুষ হঠাৎ করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ভীষণরকম গোঁড়া হলে, সেই গোঁড়ামির দূর্গ গড়ে যা কিছু অপ্রাপ্য এইবার ছিনিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। আর ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নয়, এইবার আমারটা আমার তোমারটা তোমার। কোনো ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে না।
এই নীতির পরিণাম কী ভাবার সময় নেই। আমরা স্থির করে নিয়েছি, দল পাকিয়ে ফেলেছি, এখন শুধু তুমি হয় সরে যাও, নয় আমাদের আধিপত্য মেনে নাও। যে কোনো আধিপত্য হতে পারে, সংখ্যগরিষ্ঠতার, অর্থের প্রাচুর্যের, বিশ্বাসের অনমনীয় জেদাজেদির...যা কিছু হতে পারে।
ভালোমন্দ ভাবার সময় এটা নয়। এখন সবাই একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে নেমে গেছে। দেখিই না দল পাকিয়ে। দেখিই না ভয় দেখিয়ে। দেখিই না কেড়েকুড়ে।
বিচ্ছিন্নতা যখন মূলসূত্র, ভয় আর আতঙ্ক তখন স্বাভাবিক সেন্টিমেন্ট। যে ভয় দেখায়, আর যাকে ভয় দেখানো হয় দুই পক্ষই আতঙ্কে থাকে। আতঙ্ক আছে বলে যে উল্লাস থাকতে পারে না, হুল্লোড়, উৎসব থাকতে পারে না, এ ভুল ধারণা। আতঙ্ক ফল্গুধারার মত চলে। বাইরে এলে সে উদ্বেগ। উদ্বেগ চেপে রাখার জন্যেই তো এত আয়োজন। কিন্তু আতঙ্ক? চেপে রাখা যায় না। সেটা আমাদের চেতনার অববাহিকায় এত গভীরের স্রোত, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তবে কি আমাদের ভবিষ্যৎ আতঙ্কস্রোতী? যদি এইভাবে চলে আগামীদিনগুলো তবে অবশ্যই তাই। আতঙ্ক প্রাণীমাত্রকেই অতিরিক্ত সতর্ক করে। আমরাও প্রাণী। কোনো রাস্তায় সাপ আছে জানলে অতিরিক্ত সতর্ক হয়েই চলি। প্রকৃতির এমনই নিয়ম। সেই অতিরিক্ত সতর্কতার মধ্যে প্রথমে অ্যাডভেঞ্চার। উত্তেজনা। নতুনের আস্বাদ। ধীরে ধীরে ক্লান্তি। অবসাদ। যত অবসাদ তত ক্রুরতা। নিষ্ঠুর বেড়াজালে নিজের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার প্রবৃত্তি। অন্যের আতঙ্ককে কায়েমি করতে নিজের আতঙ্ককে জাস্টিফাই করতে হয়। সেই জাস্টিফিকেশানের হাত ধরে জন্মায় একে একে সুকৌশল বর্বরতা।
আশঙ্কা বুদ্ধির অভিব্যক্তি। তার সঙ্গে যুক্তিবিচার চলে। কিন্তু আতঙ্ক বুদ্ধিবিচার নাগাল পাওয়ার আগেই জন্মে যায়। সারমেয়ের ঘ্রাণশক্তির মত। সে একটা ইনস্টিংক্ট। সে বুঝতে পারে সে সুরক্ষিত নয়। সেটা তার স্বস্তি কেড়ে নেয়। স্বাভাবিকত্ব কেড়ে নেয়। যাবতীয় প্রাণের সরঞ্জামকে ধার দিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ম ফলার মত বানিয়ে আত্মরক্ষায় নেমে পড়ে। যদিও জানে, অবশেষে হয় তো পারবে না। আর এই জানাটাই তাকে বিপন্ন করে তোলে। জীবনের সবটুকু রস মাধুর্য কেড়ে নিয়ে তাকে ছিবড়ে বানায় না, তাকে যন্ত্র বানিয়ে তোলে। সে যন্ত্র রাষ্ট্রের কোনদিকে কার কাজে লাগবে সে একমাত্র বলতে পারে সময়। সময় বলবতী। সময় রহস্যময়।
আমার চারপাশ আর আমি এই আতঙ্ক আর বিপন্নতার গ্রাসে চলে যাচ্ছি রোজ অল্প অল্প করে। ঘুম থেকে উঠেই জানি, আমি সুরক্ষিত নই। ঘুমাতে যাওয়ার আগে জানি, আমি সুরক্ষিত নই।
এই বিপন্নতার ক্ষেত্রে রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে ধর্ম। ধর্মের অনেক সংজ্ঞা হয়। কিন্তু এখানে ধর্ম একটা অবসেসান তৈরি করাতে। এ ধর্ম মরমীর না, সাধকের না। এ ধর্ম বিপন্নতার প্রতিক্রিয়ায় জাগা ধর্ম। এ ধর্ম তাবিজ, মন্ত্রের ধর্ম। এ ধর্মই নেশার ধর্ম। বারবার এক কাজ করে যাও। একটা প্যাটার্ন ফলো করো। ঘোর লাগবে। মনে হবে তুমি সুরক্ষিত সেই বলয়ে, যে বলয় তোমার ঘোর তোমার চারপাশে তৈরি করেছে। এ একটা ডিনায়াল মোড। কিন্তু পজিটিভ অ্যাটিটিউডে তৈরি করা। “এই যে আমি এত কিছু করছি, কই বসে তো নেই, আমার মত আমি তো চেষ্টা করেই যাচ্ছি”.....সে জানে, আবার জানেও না কাকে সে ঠকাচ্ছে। কিন্তু আতঙ্ক-বিপন্নতা থেকে বাঁচতে এই তার হাতের কাছে পাওয়া ডিফেন্স মেকানিজম।
স্বস্তি কীসে পায় মানুষ? সংহতিতে। সুরক্ষায়। স্বমর্যাদায়। আতঙ্ক কী দেয় মানুষকে? বিপন্নতা। বিপন্নতা কী কাড়ে? যা স্বস্তি দেয় সে সব কিছুই। মানুষের মঙ্গল কীসে? উত্তর এসেছিল সংহতিতে। সেই আদিম যুগে যে কারণে মানুষ একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিল, গাছের ডালে, গুহায়, মাটির বাড়ি, কাঠের বাড়ি, ইগলু, পাকাবাড়িতে। একসঙ্গে থাকতে থাকতে কবে সম্প্রদায় হল। জাতি হল। কিন্তু বিদ্বেষ? কে তৈরি করল? সম্প্রদায় তৈরি করল না, ভিন্নতা তৈরি করল না। বৈচিত্র্য বিদ্বেষ তৈরি করে না। ভেদবুদ্ধি তৈরি করে। ভেদবুদ্ধি মানে অন্যেকে আলাদা জানা শুধু না, আমার বিরোধী জানা। তখন বৈচিত্র্যকে আমার অস্তিত্ব বিরোধী লাগতে শুরু করে। আমি ক্রমে আতঙ্কিত হই। অন্যকে আতঙ্কিত করি। নিজে বিপন্ন হই, অন্যকে বিপন্ন করে তুলি। জয়পরাজয়, স্থিতি আমার লক্ষ্য না। আমার কোনো লক্ষ্যই নেই তখন। আমি শুধু আমার আতঙ্কতে জর্জরিত। আমি নিজেকে নিজে ধ্বংস করলেও আমার চলবে, তবে আগে তোমাকে ধ্বংস করে। এ খেলার শেষ কোথায়? শেষ নেই। চোখের বদলে চোখ, একদিন গোটা দুনিয়া অন্ধ।
উপনিষদ মানবিক সত্যকে দেখতে চেয়েছিলেন একটা মন্ত্রে - শান্তং শিবম অদ্বৈতম। এই মন্ত্রের মধ্যে। আমায় ভয় দেখালেই আমি ভয় পাব কেন? আমি শান্ত হব। আমি শান্ত হলে আমি সঠিক, সংগত রাস্তা খুঁজে পাব, যা শিবম। তবেই আমার মধ্যে আর সমাজে সংহতিতে স্থির হতে পারব। জীবন সার্থক হবে। যা অদ্বৈতম।