মানুষকে অভিনয় শিখতে হয় না, সে ক্ষমতা নিয়েই সে জন্মায়। প্রাণীদের জগতে যেমন অনুকৃতি, মিমিক্রি, এও তেমন। কখনও শিকার হতে বাঁচতে, কখনও শিকার করতে।
মিথ্যা বলা এই অভিনয়েরই একটা অঙ্গ। গল্প বলাও তাই। ওটাই বেঁচে থাকার ইনসুলেশান। নইলে বাস্তবের আগুনে ঝলসে যাবে মানুষ।
মানুষের বস্তুজ্ঞান হয়েছে ঢের। সে বিশ্বপ্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করে করে তার অনেক গভীর রহস্যে জেনে চলেছে। বস্তুজ্ঞানের ভাণ্ডার বেড়েই চলেছে। কিন্তু বাস্তবজ্ঞান? সে অলীক কথা। অসম্ভব কথা। বাস্তব বলে কিছু হলে তো সে নিয়ে তার জ্ঞান হবে। তার সাধারণত্বের জ্ঞান হতে পারে। যেমন আজ সোমবার, সেপ্টেম্বর মাস। পৃথিবীর একটা ভূখণ্ডে এ সত্য। সেই সাধারণত্বও বাস্তব না।
বাস্তব নেই। তবে কী আছে? অভিনয়। ভালো অভিনয় আর খারাপ অভিনয়। বুদ্ধি-বিচার-আবেগ-অনুভূতি-স্মৃতি নির্ভর তার যে জটিল অন্তঃকরণ, সেখান থেকে তাকে ভীষণ জটিলতর এই জগতের মধ্যে চলতে হয়। পদে পদে আশঙ্কা, ভয়। কী সম্বল তার? কিছু অভিনয়ের পাঠ। যা তাকে সমাজ আজন্ম শিখিয়ে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোড অব কন্ডাক্ট। কখন কীভাবে চলতে হয়। ভদ্রতা কাকে বলে। শালীনতা কাকে বলে।
কিন্তু এর বাইরেও সে আরেক অভিনয়ের ক্ষমতা রাখে। খলের অভিনয়, শঠের অভিনয়, ক্রুরের অভিনয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখানে একটা সংশয় আসে। ওসব কে অভিনয় বলছি কেন? আজ জগত জুড়ে রাষ্ট্রনায়কদের হাতে যে নিধনলীলা চলছে, সে কি অভিনয়? সে তো তাদের সত্যকারের রূপ।
না, মানুষের সত্যকারের রূপ বলে কিছু হয়ই না। মানুষ ভীষণরকম আনপ্রেডিক্টেবল জীব। তার সবটাই জটিল অন্তঃকরণের জটিল সমীকরণ।
মানুষ অভিনয় ছাড়া থাকতে পারে না তার কী প্রমাণ?
মানুষের নিজের সঙ্গে নিজে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। তার কিছু না কিছু করা লাগে। গান, কবিতা, সিনেমা, খেলা, কল্পনা….ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমানে এই গ্যাজেটের যুগে সে নিয়ে ভাবনা নেই। নানা পদ্ধতি আছে নিজের সামনে থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার। আত্মসমীক্ষা, ধ্যান ধ্যান খেলা, সে সব চিরকালীন খেলাও আছে। কিন্তু আদতে এ সবই সরে সরে থাকার চেষ্টা।
একাকীত্ব নেই? আছে। সে তো নিজের সঙ্গে নিজের দুঃসহ বোঝাপড়া। স্মৃতির ভারে পীড়িত।
বেশ। কিন্তু নির্জনবাস নেই?
আছে। ভীষণ কঠিন। ওই এক সময় আমি নিজের মুখোমুখি, সব অভিনয় ছেড়ে। নিজের সঙ্গে নিজের অভিনয় চলে না তা নয়। বেশ চলে। কিন্তু একটা স্তর অবধি। সেটা ছাড়িয়ে গেলে ৩৬০ ডিগ্রির মধ্যে একা। অভিনয়ের সব সাজসরঞ্জাম, সব চরিত্র-উপাধি, সব সংলাপ, চিত্রনাট্য বিকল। এ মুহূর্তটা আমাদের সবার জীবনে অত্যন্ত ক্ষণিকের জন্য এসেই মিলিয়ে যায়, যখন গভীর ঘুম থেকে সদ্য জাগার স্তরগুলো একে একে খোলে। আচমকা এই স্তরটার সামনে এসেই চলে যায়। অনেকে খেয়াল করে। অনেকে করে না। কারোর মনে হয়, ভীষণ শূন্যতা। কারোর মনে হয়, খাদ। কারোর মনে হয়, গভীর স্থবিরতা।
বাইরে, ভেতরে, ভালো মন্দ সব অভিনয় ছেড়ে কি নিজের সঙ্গে নিজে বসব? বসার পর ধীরে খুঁজব, কই কই? আর কই! কোথাও কোনো কেন্দ্র নেই। এত ইঙ্গিত, এত ইচ্ছা, এত বাসনা, এত এত শখ, স্বপ্ন - সবই অনেক বাইরের স্তর থেকে উৎপত্তি। বাইরে জটিল নেটওয়ার্ক বানানো আছে। সেখান থেকেই সব কিছু অপারেট হয়। এত গভীরে ওসব কিচ্ছু নেই। এত গভীরে কেউ-ই আসে না। গভীর সমুদ্রের মত শান্ত।
সেই নীরবতায় সজ্ঞানে পৌঁছায় কেউ কেউ। ঘুমের গভীরে পৌঁছায় সবাই। অভিনয়ের সব সাজসরঞ্জাম, সংলাপ, কস্টিউমস, উপাধি বাইরের ঘরে রেখে নিদ্রার গভীরে আত্মলীন হতে না পারলে পরেরদিনে ক্লান্তির পর ক্লান্তি। কোনো অভিনয়েই আত্যন্তিক সুখ নেই, সার্থকতা নেই। না ভালোর, না মন্দর। ভালো সত্যগামী এই যা। সত্য নয়। সত্য কী তবে? নীরবতা। বলবে কে? বললেই তো, নেই! অভিনয়ের আরেক মাত্রা শুরু। জ্ঞানীর অভিনয়।