Skip to main content

 

003.jpg

 

দরজাটা ভেজানো ছিল। গরমের দুপুর। হাতে কাজ নেই। ঝিম ধরে এসেছিল মন্মথের। চেয়ারে বসে বসেই ঝিমাচ্ছিলো। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হতে, ডান চোখটা খুলে, এক হাতে ঠোঁটের ডানদিকে এলিয়ে পড়া লালটা মুছে জিজ্ঞাসা করল, কে?

কেউ উত্তর দিল না। দরজাটা খুলল। আবার বন্ধ হয়ে গেল। মন্মথ আবার জিজ্ঞাসা করল, কে?

এইবার তার বাঁ চোখটাও খুলে গেছে। সামনে ডাইনিং টেবিলে দাঁড়িয়ে দুটো কুচকুচে কালো বেড়াল। তার দিকে তাকিয়ে।

মন্মথ সোজা হয়ে বসল। নিজের অজান্তেই জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

কেন জিজ্ঞাসা করল? ওরা তো মানুষ না। তবে কি ঘুমের ঘোর কাটেনি বলে?

দুটো বেড়াল পেছনের পা দুটো ভাঁজ করে বসল। লেজটা ধীরে ধীরে বাঁ থেকে ডান, আবার ডান থেকে বাঁ ঘোরাতে লাগল।

এমন সময় দেওয়াল ঘড়ি থেকে দুটো পাখি বেরিয়ে এসে বাজল, টিং টং টিং টং। চারটে বাজল।

মম্মথ ঘরের চারদিক তাকালো। আধখাওয়া বিরিয়ানি, ফাঁকা মদের বোতল মেঝেতে গড়াচ্ছে। সিগারেটের ছাই চারদিকে। নিরামিষ না হলে টেবিলে বসে খায় না মন্মথ।

একটা বেড়াল লাফ দিয়ে মন্মথের বাঁ থাইতে এসে বসল। ল্যাণ্ড করলই বলা যায়। জিন্‌সের মধ্যে সরু তীক্ষ্ম নখগুলো ঢুকিয়ে দিতে দিতে তারদিকে স্থির চোখ মেলে তাকিয়ে। কাকে পর্যবেক্ষণ করছে, তাকে, না যন্ত্রণার তীব্রতাকে?

রক্ত বেরোচ্ছে। বুঝতে পারছে মন্মথ। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারছে না। সারাটা শরীর অবশ। রক্ত থাই গড়িয়ে হাঁটুর নীচ দিয়ে নামছে। খালি পায়ের উপর ছুঁলো। এইবার মেঝেতে। আড়চোখে দেখল। ঘন লাল রঙের স্রোত। দুটো মাছি এসে বসল। একটা লাল, একটা নীল। মুহূর্তে জানলার কাঁচে মাছির শিলাবৃষ্টি হতে শুরু করল। মন্মথের রক্তের স্রোত ততক্ষণে বাথরুমের সামনে অবধি চলে গেছে। ক'টা কালো লোমশ মাকড়সা বাথরুম থেকে বেরিয়ে রক্তের উপর এসে বসল।

“কী গো…. দরজাটা খোলা কেন? ইস….ঘরের কী করেছ?”

ঝুমা। কাজের বৌদি। ঘরে এসে মন্মথের দিকে না তাকিয়ে এঁটো থালা গেলাস মেঝে থেকে নিয়ে সিঙ্কে চলে এলো। মাজতে মাজতে শিস দিয়ে গান গাইছে। ওর গা থেকে সেই চেনা পারফিউমের গন্ধটা আসছে।

“পারফিউম মেখে কাজে আসো কেন ঝুমা?”

ঝুমা হেসেছিল। উত্তর দেয়নি।

বাসন মাজতে মাজতে বলল, চা খাবে? আমার হেব্বি মাথা ধরেছে। দেব?

মন্মথের অবাক লাগছে। ও বেড়ালটা দেখতে পাচ্ছে না? মন্মথ জিজ্ঞাসা করতে চাইল, তুমি কিছু দেখছ না?

বলতে পারল না। বলল, না। চা খাব না। তুমি মেঝেটা ঝাঁট দিয়ে দাও না প্লিজ…..

প্লিজ!! ঝুমা হাসল। সিঙ্কের কলটা খোলা রেখেই ঝাঁট দিতে শুরু করল। বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি। কদাকার। কিন্তু ভালো। আজ ভালো লাগছে না। ভয় করছে। রক্তের স্রোত ওর ঝাঁটাকে ছুঁলো না। টেবিলে বসে থাকা বেড়ালটা ঝুমাকে দেখছে। আচমকা ঝুমার পাছার উপর গিয়ে হামলে পড়ল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিল মন্মথ। পা’'টা যন্ত্রণায় টাটাচ্ছে।

ঝুমা চায়ের জল বসিয়ে রান্নাঘরের জানলার বাইরে তাকিয়ে। রোদ এসে পড়েছে ঝুমার কালশিটে পড়া, রঙচঙ করা মুখে। যেন বিসর্জনের প্রতিমাকে আবার সাজিয়ে এনেছে প্যাণ্ডেলে। মোচ্ছব করবে বলে। বেড়ালটা এখনও পাছা কামড়ে ঝুলে আছে ঝুমার।

হঠাৎ পায়ের কাছে কী ঠেকল। তার স্লিপারটা। মন্মথ এক ঝটকায় ছুঁড়ে মারল ঝুমার পাছা লক্ষ্য করে। টিপ অব্যর্থ। কিন্তু উদ্দেশ্য না। বেড়ালটা তার আগেই দুঁদে গোলকিপারের মত ঝুমার ডানদিকের পাছা ছেড়ে বাঁদিকে গিয়ে ঝুলে পড়েছে। চটিটা লাগল সজোরে। ঝুমা আঁক করে ঘুরে তাকালো। তার হাতে লেগে চায়ের সসপ্যান পড়ল ফুটন্ত জল নিয়ে মাটিতে। মোবাইল ছিটকে গেল জানলা দিয়ে বাইরে। ঝুমা তাকে কিছু বলার আগে দৌড়ালো বাইরে। মোবাইলটা এই কদিন হল কিনেছে। পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে।

ঝুমাকে ছেড়ে কালো বেড়ালটা এসে বসল আবার টেবিলে। ওর সবকটা দাঁতে রক্ত লেগে। ঝুমার রক্ত। জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে বেড়ালটা তাকালো ঝুলবারান্দার দিকে। হঠাৎ তীব্র হইচই গাড়ির আওয়াজ।

মন্মথ উঠল কোনোরকমে। বেড়ালটা এবার তার থাই আঁকড়ে জড়িয়ে। হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিজেকে নিয়ে গেল ঝুলবারান্দা অবধি। তার ফ্ল্যাটটা চার তলায়। নীচে রক্তাক্ত ঝুমা লুটিয়ে আছে রাস্তায়। একটা বাসে ভাঙচুর চলছে। বাসের পিছনের চাকা থেকে রক্তের প্রলেপ রাস্তায়।

======

এখন রাত এগারোটা। পুলিশ এসেছিল। কয়েকটা প্রশ্ন করে চলে গেছে। পুলিশ থাকাকালীন বেড়ালদুটোকে দেখেনি মন্মথ। ওরা চলে যাওয়ার পর ঝুলবারান্দা থেকে লাফিয়ে ঘরে ঢুকল।

মন্মথ সোফায় বসে। ওরা সামনের ডাইনিং টেবিলে। তার দিকে তাকিয়ে নেই। ঝুলবারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দুজনেই। মন্মথ উঠে জল নিল। জল খেল। প্যান্টটা খুলে শুধু শর্টস আর টিশার্ট গায়ে বেডরুমে এসে ঢুকল। এসিটা অন করে গায়ে চাদরটা টেনে ঘুমিয়ে পড়ল।

=====

ঘুম ভাঙল সকাল ন'টায়। ফোনে চার্জ শেষ। বন্ধ ফোনের স্ক্রিনে নিজের মুখটা দেখে চমকে উঠল। একটা কালো কুচকুচে বেড়াল। খাট থেকে লাফ দিয়ে নামল। চারপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বসার ঘরে এলো। কেউ নেই।

ঘরে এসে লাফ দিয়ে খাটে উঠল। লাফ দিয়ে আলমারির মাথায় চড়ল। বাইরে এলো। ঝুলবারান্দায় এলো। দেখতে দেখতে দুপুর গড়ালো। মন্মথ দেখল সার দিয়ে কালো বেড়াল বেরোচ্ছে শহর জুড়ে। একে একে এর ওর বাড়ির দরজা, জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ছে। তার হাত-পা নিশপিশ করতে শুরু করল। কিছু ভাবার আগেই লাফ দিল। সামনের অর্জুন গাছটায় পড়ল। তারপর প্লাস্টিকের কারখানার কার্নিশ বেয়ে বেয়ে নীচে নেমে রাস্তায় এলো। এত কালো বেড়াল চারদিকে, তার বাড়ি কারা গিয়েছিল চেনা শক্ত। দরকারও তো নেই।

মন্মথ হাঁটছে। সামনে একটা বেড়ালের হাঁটা দেখে মনে হল ঝুমা। ঝুমা কী? বেড়ালটা ফিরে তাকালো। লাফ দিয়ে সিনেমা হলের ভেতর চলে গেল। এই সিনেমা হলে আসেনি কোনোদিন মন্মথ। এখানে সমাজের নীচুশ্রেণীরা আসে। রদ্দি পর্ণ দেখায়। বেড়ালদের শ্রেণী হয়? আজ না, অন্যদিন গিয়ে দেখবে। আজ কোথায় যাবে মন্মথ?

জিভটা শুকাচ্ছে। রক্তের তৃষ্ণা জন্মাচ্ছে। মন্মথের মাথা থেকে রাশি রাশি মুখ ভেসে উঠতে লাগল। এত এত মানুষের রক্তের তৃষ্ণা জমে আছে মাথায়। দু একজনের মুখের সঙ্গে কাল আসা দুটো বেড়ালের মুখের মিল পেল যেন।

মন্মথ দ্রুত পায়ে এগোতে শুরু করল। কার রক্তের স্বাদ প্রথম সে চায় বুঝে গেছে। শুধু ভয় হচ্ছে সে তার আগে বেড়াল হয়ে যায়নি তো? পেছনে পেছনে আরো কারা যেন আসছে। কানের কাছে মাছি ভনভন করছে। মন্মথ এগোচ্ছে রাতের বুক চিরে। রক্তের তৃষ্ণা শুধু কি তার একার?